শুক্রবার, ১০ই অক্টোবর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৫শে আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ

*** আওয়ামী লীগের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাচ্ছে আমেরিকা, ইউরোপের আপত্তি শরিয়া শাসনে! *** শনিবার ভোরে দেশে ফিরছেন শহিদুল আলম *** ইসরায়েল থেকে মুক্ত শহিদুল আলম এখন তুরস্কে *** স্বামী নিখোঁজের পর দেবরের সঙ্গে বিয়ে, পরের দিনই হাজির স্বামী! *** সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর শরৎ উৎসব স্থগিত নিয়ে যা জানাল চারুকলা অনুষদ *** গাজায় যুদ্ধবিরতি ‘কার্যকর’, নিজ এলাকায় ফিরছেন ফিলিস্তিনিরা, সরছেন ইসরায়েলি সেনারা *** ট্রাম্প নোবেল শান্তি পুরস্কার না পাওয়ায় যা বলছে হোয়াইট হাউস *** তালেবানের সঙ্গে বৈঠকের পর কাবুলে পূর্ণাঙ্গ দূতাবাস চালুর ঘোষণা দিল্লির *** গুমের ঘটনায় ২৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ন্যায়বিচারের পথে অগ্রগতি: এইচআরডব্লিউ *** শেখ হাসিনাসহ দুই ডজন নেতা ভোটে অযোগ্য হচ্ছেন

যেভাবে ৫০ বছর পর নরওয়েজিয়ান এলিজাবেথ ফিরে পেলেন মা ফিরোজাকে!

নিউজ ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ০৬:৫০ অপরাহ্ন, ২৮শে মার্চ ২০২৪

#

ছবি: সংগৃহীত

৫০ বছর আগে হারিয়ে ফেলা মা ফিরোজার কাছে অবশেষে ফিরেছেন নরওয়েজিয়ান এলিজাবেথ। তবে জন্মদাত্রী মাকে খুঁজে পাওয়ার যাত্রা মোটেই সহজ ছিলো না এলিজাবেথের। 

সম্প্রতি নরওয়ে থেকে শেকড়ের টানে বাংলাদেশে আসেন এলিজাবেথ। শুরু করেন মাকে খুঁজে পাবার এক অসম্ভব লড়াই। পাশে পান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সমাজসেবা অধিদপ্তর ও বিভিন্ন কর্তৃপক্ষকে। 

১৯৭৫ সালে কিশোরী মা ফিরোজা বেগমকে হারান তিনি। দেড় মাস বয়সী মৌসুমিকে (এলিজাবেথ) শিশু সদনে রেখে আসেন অসহায় ফিরোজা।


সেখান থেকে তাকে দত্তক নেয় নরওয়ের রয়-রেড দম্পতি। মৌসুমির নাম হয় এলিজাবেথ। ৫০ বছর পর, বৃহস্পতিবার ( ২৮শে মার্চ) শিবচরের পদ্মেরচর গ্রামে জন্মদাত্রী সেই মায়ের দেখা পেলেন এলিজাবেথ।

নরওয়ের আরেন্ডাল শহরে স্বামী হেনরিক ফাজালসেট আর চার সন্তান নিয়ে বাস করেন প্রায় ৫০ বছর বয়সী এলিজাবেথ ফিরোজা ফাজালসেট। কিছুদিন আগেই বড় ছেলে থিও বিয়ে করেছেন। এলিজাবেথ পেশায় একজন স্বাস্থ্যকর্মী। আরেন্ডালেরই একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তিনি। সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন কাটালেও এলিজাবেথের মনে অন্যরকম এক হাহাকার।

আরো পড়ুন: কোরআনের হাফেজদের জন্য সিএনজি ভাড়া ফ্রি!

এলিজাবেথ জানেন না কার গর্ভে তার জন্ম হয়। শুধু জানেন, জন্মদাত্রী মায়ের নাম ফিরোজা বেগম, বাবা মৃত বশির সরদার। জন্ম হয়েছিলো বাংলাদেশের ঢাকা শহরে। আর এই তথ্যও  সে পেয়েছে প্রথম পাসপোর্ট আর নরওয়ের দত্তক নেয়া পরিবারের কাছে থাকা দলিল থেকে।

এলিজাবেথ ওরফে মৌসুমী নরওয়েতে দত্তক সন্তান হিসেবে যাওয়ার পর আক্ষরিক অর্থেই নতুন জীবন পেয়েছিলেন। পাসপোর্টে যার নাম ছিল মৌসুমী। নতুন দেশে গিয়ে নাম পাল্টে হয় এলিজাবেথ ফিরোজা রয়েড। অবশ্য ফিরোজা নামটি এসেছে পাসপোর্টে থাকা মা ফিরোজা বেগমের নাম থেকে। বিয়ের পর পেয়েছেন ফাজালসেট পদবী।

মৌসুমী থেকে এলিজাবেথ রয়েড

১৯৭৫ এর ১৫ই জুলাই জন্ম হয় মৌসুমীর। জন্মের পাঁচ মাস আগেই তার বাবা বসির সরকার খুন হন। ১৩ বছরের কিশোরী ফিরোজা বেগম হয়ে পড়েন দিশেহারা। ফিরোজার নিজের বাবাও মারা গেছেন।

নবজাতক সন্তানকে কী করে বড় করবেন সে চিন্তায় তিনি পাগল প্রায়। মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো লাভ হয়নি। তখন এক প্রতিবেশী তাকে পরামর্শ দেয় সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের শিশু সদনে শিশুটিকে দিয়ে দেয়ার। ১৯৭৫ সালে ৩০শে আগস্ট ঢাকায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের শিশু সদনে দেড় বয়সী শিশুকে বিনা শর্তে দিয়ে যান ফিরোজা বেগম। কখনো আর ভাবেননি মেয়েকে ফিরে পাবেন।

অন্যদিকে ডাক্তার রয় রয়েড আর তার স্ত্রী ক্যারেন রয়েড একটি আবেদন করে বাংলাদেশ সরকারের আন্তঃদেশীয় দত্তক প্রকল্পে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে। ১৯৭৫ সালের ১৭ই জুলাই আবেদন করে তারা একটি শিশু সন্তান চান। সংযোগ ঘটে রয়-রযেড দম্পতির সাথে মৌসুমীর। এরপর চুক্তি, দুই দেশের মধ্যে কাগজপত্র লেনদেন আর পাসপোর্ট করে চার মাস বয়সী ছোট্ট মৌসুমী পাড়ি জমায় নরওয়ে। নতুন নাম হয় এলিজাবেথ ফিরোজা রয়েড।

চিকিৎসক রয় রয়েড আর গৃহিনী মা ক্যারেন এলিজাবেথের এর কাছে যত্নে বড় হতে থাকেন এলিজাবেথ। ১০ বছর বয়সে প্রশ্নের জবাবে দত্তক বাবা-মা জানায় বাংলাদেশের একটি এতিমখানার সিঁড়িতে তাকে কুড়িয়ে পেয়েছিলো।

অসলো বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা করেন এলিজাবেথ ফিরোজা। সেখানেই পরিচয় হেনরির সাথে। নিজে স্বাস্থ্যকর্মী আর ঘর বাঁধেন সমাজকর্মী হেনরির সাথে। ২২ বছর বয়সে প্রথম সন্তান জন্মের আগে ডাক্তার জানতে চান এলিজাবেথের বাবা-মায়ের কোনো অসুখ ছিল কি না। জানতে চান পরিবারের পুরো ইতিহাস।

এলিজাবেথের মনে নতুন করে প্রশ্ন জাগে তার জন্মদাত্রী মা কে? তার পরিবার কোথায়? প্রথম সন্তান জন্মের পর এই প্রশ্নটি আরও কঠিন হয়ে তার সামনে দেখা দেয়। বারবার তার মনে হয় তার মাও তাকে এতখানি প্রসব বেদনা নিয়েই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিলেন।

মাকে খোঁজার নতুন যুদ্ধ 

শুরু হয় মাকে খোঁজার নতুন যুদ্ধ। ২০১৩ সালে একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। সেবার খালি হাতেই ফিরতে হয়েছিলো তাকে। তবে বাংলাদেশি বন্ধু ক্রিস্টোফার কে বলে গিয়েছিলেন আবার আসবেন তিনি। নরওয়েতে বিভিন্ন শিশু সদনে এর জন্য কাজ করতে শুরু করেন। গান গেয়ে শোনান তাদের। ধীরে ধীরে মাকে খোঁজার কাজটি এগিয়ে নেন। নরওয়ের বিভিন্ন দপ্তরে দত্তক সম্পর্কিত কাগজগুলো জোগাড় করেন। সেখানে বাংলাদেশে তার ঠিকানা সম্পর্কে তেমন কিছুই ছিলো না।

কিন্তু তার নিজের জন্মদাত্রী কিংবা পরিবারের খোঁজ লাগবেই। জানতেই হবে, কী তার আসল পরিচয়, কেন তাকে দেয়া হয়েছিল দত্তক, কারা তার আপনজন।  চার বছর ধরে টাকা জমান বাংলাদেশে আসার জন্য।

গত ২৩শে মার্চ আবার আসেন বাংলাদেশে। এরই মধ্যে যোগাযোগ করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক মোস্তফা জামিল খানের সাথে। সেখান থেকে যান সমাজ সেবা অধিদপ্তরে। সমাজসেবা অফিসার আবু নাঈম খুঁজে বের করেন ৫০ বছরের পুরনো ফাইল। নতুন করে আশার আলো দেখেন এলিজাবেথ। জানতে পারেন তার গ্রামের নাম পদ্মের চর, ইউনিয়ন মাদবরচর, উপজেলা শিবচর, জেলা ফরিদপুর (বর্তমান মাদারীপুর)।

৫০ বছর পর মা-মেয়ের মিলন 

দত্তক নেয়া সংক্রান্ত কাগজপত্র, পাসপোর্টের অনুলিপি এলিবাথে দেন একাত্তর টিভিকে। দত্তক নেয়ার কাগজে লেখা রয়েছে প্রকৃত বাবা-মায়ের নাম। সেখানে দেখা যায়, সমাজসেবা অধিপ্তরের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ২২শে ডিসেম্বর তাকে দত্তক দেয়া হয়। সে সময় তার বয়স ছিলো মাত্র চার মাস। দত্তক দলিলের তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে মৌসুমী। আর তার জন্মস্থান হিসেবে লেখা হয়েছে ঢাকা। দত্তক দেয়ার কারণ হিসেবে মৌসুমীকে ‘এতিম’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাবাকে মৃত এবং মাকে জীবিত দেখানো হয়েছে।

এলিজাবেথের যুদ্ধ তখনও বাকি। ঠিকানা পাওয়ার পর শুরু হয় শ্বাসরুদ্ধকর স্থানীয় পর্যায়ের খোঁজ-খবরের। অনেক খবর আসতে থাকে। তার জন্মদাত্রী মারা গেছে বলেও খবর পান। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে কর্মী, সবাই মিলে খুঁজে একজন দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের খোঁজ দেয়।

সেই আত্মীয় সেলিম সরদার খবর দিলেন ফিরোজা বেগম বেঁচে আছেন। তার মায়ের আবার বিয়ে হয়েছে। খবর পাঠানো হয় ফিরোজা বেগমকে। ছুটে আসেন সেলিম সরদারের বাড়িতে। এরপর এক অন্যরকম দৃশ্য। মা বা মেয়ে কেউ কারো কথা বোঝেন না কিন্তু ইশারায় চলে ভাব বিনিময়।

৬৩ বছর বয়সী ফিরোজা বেগম জানান কতটা অসহায় হয়ে মেয়েকে তিনি দিয়ে দিয়েছিলেন। কোনদিন আর দেখতে পাবেন এমনটাও প্রত্যাশা করেননি। মায়ের চোখের কান্না আর থামে না। ফিরোজা বেগম মেয়ে এলিজাবেথকে কোলেও নিতে চান। অন্যদিকে এলিজাবেথ গণমাধ্যমকে বলেন, আমি বড় হয়ে গেছি তুমি আমার কোলে আসো।

মায়ের জন্য উপহার এনেছেন। মাকে দেখান তার ছোটবেলার ছবি। তার সন্তানদের ছবি ও দেখান। শেষ দুই বছর এক মুহূর্তের জন্যও এলিজাবেথ জন্মভূমি আর মায়ের কথা ভুলতে পারেননি। বারবার বলছিলেন, না জানা কতটা কষ্টের। আজ তার নিজেকে পূর্ণাঙ্গ মনে হচ্ছে। তবে দত্তক দিয়ে দেয়ার জন্য মাকে তিনি কখনোই দায়ী করছে না। মায়ের সেই সময়ের অসহায়ত্বকে তিনি বুঝতে পেরেছেন। 

নরওয়েতে একটি ভালো পরিবারের মাঝে বড় হয়েছে এজন্য কৃতজ্ঞতা জানায় ফিরোজা বেগমের প্রতি। নরওয়ের বাবা-মায়ের প্রতি রয়েছে অসীম ভালোবাসা। জীবনসঙ্গী হেনরিক তার চোখে পৃথিবীর ভালো মানুষদের একজন।

দত্তক শিশু জেনেও যে তাকে জীবনসঙ্গী করেছেন। মাকে ফিরে পাবার যুদ্ধ যে সবসময় পাশেই ছিলো। ২৬ বছরের থিও,২৪ বছরের পার্নিল,২০ বছরের ম্যাথিয়াস ও ১৬ বছরের অলিভারের মা এলিজাবেথ ফিরোজা আজ মায়ের সন্ধান পেয়ে নিজেই যেন শিশু হয়ে উঠেছেন।

বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসায় তিনি আপ্লুত। কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সমাজসেবা অধিদপ্তর, মাতবরচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফজলুল হক আর গণমাধ্যমকে । বার বার ফিরে আসার অভিপ্রায় জানান এলিজাবেথ ।

এইচআ/ 

এলিজাবেথ মা ফিরোজা মা-মেয়ের মিলন

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন

Footer Up 970x250