ছবি: সংগৃহীত
অপূর্ব বালা, সহকারী জজ, বরগুনা
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে হিন্দু পারিবারিক আইনের কোনো ধরনের সংস্কার হয়নি। হিন্দুদের বিয়ে, উত্তরাধিকার ও বিচ্ছেদ (ডিভোর্স- হিন্দুদের জন্য এর বিধান নেই) দেওয়া হয় সেকেলে আইনে। বিবাহ ও উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইন হিন্দু ধর্মীয় শাস্ত্র থেকে উদ্ভূত।
সনাতন ধর্মের অনুসারী মেয়েরা উত্তরাধিকার সূত্রে চূড়ান্তভাবে সম্পত্তি প্রাপ্ত হন না। হিন্দুদের বিয়ে আত্মার সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক, এখানে মৃত্যু ছাড়া বিচ্ছেদের কোনো সুযোগ নেই। এ কারণে বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্য ডিভোর্সের বিধান নেই।
ডিভোর্স নিন্দনীয়। কেউই চান না, কোনো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ হোক। কিন্তু, কোনো কোনো দাম্পত্য জীবনে কখনো কখনো এমন অনেক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যেখানে ডিভোর্সই সমাধান। পরকীয়া, মাদকাসক্তি ও নারীর প্রতি নিষ্ঠুরতাসহ অনেক রকম পরিস্থিতি আছে, যেখানে আর সংসার টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না নারীর পক্ষে। তবু আইনত একজন হিন্দু মেয়ে স্বামীর সঙ্গে বিয়ে বিচ্ছেদ করতে পারেন না।
আত্মার সঙ্গে আত্মার সম্পর্কের দোহাই দিয়ে ডিভোর্সের বিধান না থাকা কি বিচ্ছেদ ঠেকাতে পেরেছে? অনেক হিন্দু যুগলের মধ্যে বিচ্ছেদ হচ্ছে। হয়তো সেটা আইনসম্মত নয়, তবে বিচ্ছেদ হচ্ছে। আইনের অনুপস্থিতি বিচ্ছেদ ঠেকাতে পারছে না। পারছে শুধু হয়রানি বাড়াতে।
এ দেশে একশ্রেণির মানুষ আছেন, যারা মনে করেন, হিন্দু মেয়েরা সম্পত্তি পেলে তারা ধর্মান্তরিত হয়ে যাবেন বা বিবাহ বিচ্ছেদের সুযোগ থাকলে সবাই তার স্বামীকে ডিভোর্স দেবেন। হিন্দু মেয়ে ধর্মান্তরিত হলে তার প্রাপ্ত সম্পত্তি মুসলমান বা খ্রিষ্টানের কাছে চলে যাবে, অন্য ধর্মের ওই ব্যক্তি সম্পত্তির লোভে হিন্দু মেয়েকে ফাঁদে ফেলতে পারেন, এমন যুক্তিতে অনেকে হিন্দু মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার দিতে আপত্তি করেন।
হিন্দু মেয়েরা সম্পত্তি এখন পান না। তাই বলে কি তারা ধর্মান্তরিত হচ্ছেন না? অনেকেই হচ্ছেন। ধর্মান্তরিত হলে বা হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করলে সম্পত্তি পাবেন না, এমন বিধান যুক্ত করেও সম্পত্তির অধিকার দেওয়া যায়। আর ধর্মান্তরিত শুধু কি মেয়েরা হন? সনাতন পুরুষ, বা ছেলেরা হচ্ছেন না?
ডিভোর্সের বিধান থাকলেই কি সবাই গণহারে স্বামী-স্ত্রীকে ডিভোর্স দেবেন? মুসলমানদের মধ্যে তালাকের বিধান থাকায় সবাই তালাক দিচ্ছেন? হিন্দু পুরুষ চাইলে একাধিক বিয়ে করতে পারেন। এক্ষেত্রে স্ত্রীর সম্মতি লাগে না। একাধিক বিয়েতে বাধা নেই বলে কি হিন্দু ছেলেরা গণ্ডায় গণ্ডায় বিয়ে করছেন?
আমার পরিচিত একজনের একটি ঘটনা শেয়ার করি। ভদ্রলোক কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তিসহ চার মেয়ে ও এক স্ত্রী রেখে মারা গেছেন। কিছুদিন পরে তার স্ত্রীও মারা যান। এখন চার মেয়ে তার বাবার সম্পত্তিতে চূড়ান্ত মালিকানা অর্জন করবেন না। মেয়েদের কারোর পুত্র সন্তান থাকলে তারা মালিক হবেন। কিন্তু তাদের কারোর পুত্র সন্তান এখনো পর্যন্ত নেই।
যেহেতু মৃত ব্যক্তির দৌহিত্র নেই, এ কারণে তার ভাই বা ভাইয়ের ছেলে মালিক হবেন। মৃত ব্যক্তির ভাই এখন তার ভাইঝিদের সম্পত্তি না দিয়ে নিজে সম্পত্তি ভোগ করার আশায় দিন গুনছেন। কোনো জরুরি কাজে মৃত ব্যক্তির মেয়েদের কয়েক লাখ টাকার দরকার হলে তারা বাবার কোটি টাকার সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও তা বিক্রি করতে পারবেন না। তবে বৈধ প্রয়োজনীয়তা থাকলে সীমিত ক্ষেত্রে বিক্রি করা যায়। কিন্তু, বিক্রি করতে গেলে নানাবিধ বাধা-বিপত্তির কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেটা সম্ভব হয় না।
ধরে নিই, ওই চার মেয়ের একজনের কোনো কারণে বিয়ে হলো না বা করলেন না। তিনি বাঁচবেন কীভাবে? তার কোনো আর্থিক নিশ্চয়তা আছে? আবার যদি এমন হয় যে, এক মেয়ে বিয়ে করেছেন কিন্তু স্বামী মাদকাসক্ত আর নিয়মিত স্ত্রীকে নির্যাতন করেন। সেখানে সংসার করা তো সম্ভব নয়। আবার আইনে ডিভোর্সের বিধানও নেই। মেয়েটা তার বাবার সম্পত্তিতে অধিকার পেলেন না, স্বামীর সংসারও করতে পারছেন না, আবার ডিভোর্সও দিতে পারছেন না। স্বামীকে রেখে অন্য কোথাও বিয়ে করলে মামলার ঝামেলায় পড়বেন।
‘আত্মার সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক’ তথা ডিভোর্সের বিধান না থাকা কি মেয়েটার সংসার টিকিয়ে রাখছে? ডিভোর্স হলেও মেয়েটার বাবার অনেক সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও তিনি নিঃস্ব, আর্থিক নিশ্চয়তা নেই। এ রকম পরিস্থিতিতে অনেক মেয়েই ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করছেন।
আমাদের পারিবারিক আইনে এ রকম অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক বিধান একুশ শতকেও আছে ভাবলে লজ্জা লাগে। পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে আর আমরা পড়ে আছি প্রাচীনকালের নিয়ম-কানুনের মধ্যে!
আধুনিক যুগেও ডিভোর্সের বিধান না থাকা বা মেয়েদের সম্পত্তিতে অধিকার না থাকার মতো আজগুবি আইন আর কোথাও আছে কী না, জানা নেই।
১৮৫৬ সালে ভারতবর্ষে বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়েছে। কিন্তু, এর ১৭৫ বছর পরেও এমন বৈষম্য টিকে আছে ভাবতে অবাক লাগে। দুঃখজনক হলেও সত্য, যাদের এ বিষয়গুলোর পক্ষে কথা বলার দরকার, তারাই এটার বিরোধিতা বেশি করেন। শিক্ষিত হিন্দু মেয়েদেরও এ বিষয় নিয়ে সোচ্চার হতে দেখিনি।
১৯৫৫-৫৬ সালে ভারত হিন্দু পারিবারিক আইনে পরিবর্তন এনে মেয়েদের সম্পত্তিতে সমান অধিকার দেওয়াসহ ডিভোর্সের বিধান যুক্ত করে। ১৯৬১ সালে বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য পারিবারিক আইন সংশোধন করে তিন তালাক (ইনস্ট্যান্ট ডিভোর্স) নিষিদ্ধ করাসহ এতিমদের দাদার সম্পত্তিতে অধিকার দেওয়া হয়।
অনেক ক্ষেত্রেই এসব বিধান ইসলাম ধর্মীয় আইনের পরিপন্থী। তারপরেও পরিবর্তন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে ১৯৬১ সালে মুসলিম পারিবারিক আইনে সংশোধন আনা গেলেও একই বিধান ভারতের মুসলিমদের জন্য করতে অপেক্ষা করতে হয় ২০১৯ সাল পর্যন্ত। যদিও হিন্দুদের আইন তারা ১৯৫৫/৫৬ সালেই সংশোধন করে।
মূলত সংখ্যালঘুদের পারিবারিক আইনে পরিবর্তন আনা রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর। এটা অনেক সময় তারা ধর্মীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ বা ধর্মীয় আগ্রাসন মনে করে। যে কারণে রাষ্ট্র ও সংখ্যাগরিষ্ঠদের পারিবারিক আইনে সহজে পরিবর্তন আনতে পারলেও সহজেই পারে না সংখ্যালঘুদের পারিবারিক আইনে পরিবর্তন আনতে। কিন্তু, তাই বলে কি পরিবর্তন আনা যাবে না? অন্যান্য দেশ পরে হলেও সংশোধন করেছে।
বাংলাদেশের উচিত অতি দ্রুত এসব বিষয় সংশোধন করে হিন্দু পারিবারিক আইন যুগোপযোগী করা। যুগ যুগ ধরে চলে আসা বৈষম্য ও অযৌক্তিক বিধান দ্রুত সংশোধন করে হিন্দু মেয়েদের দেরিতে হলেও মুক্তি দেওয়া হোক।
আরএইচ/এইচ.এস
খবরটি শেয়ার করুন