ছবি: সংগৃহীত
বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং ইংরেজি পত্রিকা ‘ডেইলি স্টারের’ সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম মনে করেন, জুতা ও ওষুধ কারখানার মালিক আর সংবাদমাধ্যমের মালিকের মধ্যে পার্থক্য আছে। দেশের কোনো কোনো পত্রিকার সম্পাদক ব্যক্তিত্ব হারিয়ে ও সাংবাদিকতা পেশার মর্যাদা রক্ষা না করে মালিকদের ‘জনসংযোগ কর্মকর্তায় পরিণত হওয়ার’ বিষয়টিও তিনি তুলে ধরেছেন।
১৯৭২ সাল থেকে সাংবাদিকতা এবং ১৯৯৩ সাল থেকে সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন মাহফুজ আনাম। তিনি বলেন, ‘এতো বছরের অভিজ্ঞতায় গভীর দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, সম্পাদকরা তাদের পদের মর্যাদা বাড়ানো, শক্তিশালী করা ও সম্মান বাড়ানোর পরিবর্তে ঠিক বিপরীত কাজ করছেন। তারা মালিকের জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করে সাংবাদিকতা পেশার সম্মান নষ্ট করছেন। প্রতিষ্ঠানকে কলঙ্কিত করছেন ও অপমানজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করছেন।’
প্রখ্যাত এই সাংবাদিক বলেন, ‘একজন মালিক আইনত যে কোনো ব্যবসার মালিক হতে পারেন। কিন্তু, জুতার কারখানা ও ওষুধ কারখানার মালিকানা এক নয়। জুতার কারখানার মালিক নকশা (ডিজাইন), রং, উপাদান ও আকৃতি ইত্যাদির ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারেন।’
তার মতে, ‘ওষুধ কারখানার ক্ষেত্রে মালিককে অবশ্যই পেশাদার ব্যবস্থাপনার অধীনে কাজ করতে হয় এবং বৈজ্ঞানিক মানদণ্ড অনুযায়ী কারখানা পরিচালনার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হয়। কোনো মালিক কি চিকিৎসককে বলে দিতে পারেন, কোন রোগের জন্য কোন ওষুধ লিখতে হবে?’
তিনি বলেন, ‘একইভাবে গণমাধ্যম অবশ্যই পেশাদার সাংবাদিকদের দ্বারাই পরিচালিত হতে হবে। মালিকের উচিত পেশাদারদের, বিশেষ করে সম্পাদকের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া, যাতে গণমাধ্যম তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারে ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালিত হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘কোনো মালিক সম্পাদককে কিছু প্রকাশ করতে বাধ্য করলে সম্পাদককে দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। প্রথমত, সেটি অবশ্যই তথ্যভিত্তিক হতে হবে এবং দ্বিতীয়ত, যাদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করা হচ্ছে, তাদের জবাব দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। যদি সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়, তাহলে সম্পাদকের উচিত পদত্যাগ করা এবং কীভাবে তিনি সাংবাদিকতাকে অপব্যবহারের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন, তা প্রকাশ্যে জানানো। এভাবেই সম্পাদকের প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং জনমানুষের আস্থা অর্জন করে।’
তার মতে, ‘একজন সম্পাদক হওয়ার পূর্বশর্ত শুধু লেখা, সম্পাদনা, পরিচালনা, নেতৃত্ব দেওয়া ও সাংবাদিকদের দিকনির্দেশনা দেওয়া বা অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি থাকা নয়। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পর্যাপ্ত আত্মমর্যাদা, ব্যক্তিগত দৃঢ়তা, সাহস ও সম্মানবোধ থাকতে হবে, যাতে তার নিয়ন্ত্রণাধীন গণমাধ্যমকে কখনোই মিথ্যা, মানহানি বা ঘৃণা ছড়ানোর জন্য ব্যবহার করা না হয়।’
তিনি বলেন, ‘দেশের সংবাদপত্রগুলোর বহু সংস্কার প্রয়োজন, যার মধ্যে অন্যতম হলো মালিক নিয়ন্ত্রিত সাংবাদিকতা থেকে সম্পাদক নিয়ন্ত্রিত সাংবাদিকতায় রূপান্তর। আমরা গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছি।’
সম্প্রতি ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক কলামে তিনি নিজের এসব মতামত তুলে ধরেন। সেখানে তিনি সম্পাদকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘সম্পাদকদের প্রতি অনুরোধ, অনুগ্রহ করে সম্মান বিসর্জন দেবেন না এবং মালিকদের জনসংযোগ কর্মকর্তায় পরিণত হবেন না।’
এইচ.এস/
খবরটি শেয়ার করুন