বেপরোয়া কোচিং বাণিজ্য : প্রতীকী ছবি - সংগৃহীত
শুরু হয়েছে নতুন শিক্ষাবর্ষ। এখনও অধিকাংশ শিক্ষার্থী সবগুলো বই হাতে পায়নি। কিন্তু বছরের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়েছে কোচিংয়ে পড়ানো। অনেক অভিভাবক বাসায় প্রাইভেট পড়ালেও শিক্ষকদের চাপে তাদের সন্তানকে কোচিংয়ে পাঠাতে বাধ্য হন। সম্প্রতি একাধিক জরিপ থেকে জানা যায়, প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি শিক্ষার্থী প্রাইভেট কিংবা কোচিংয়ে পড়ে। বিশেষ করে মেট্রোপলিটন, বিভাগীয় ও জেলা শহরে কোনো শিক্ষার্থী প্রাইভেট কিংবা কোচিংয়ে পড়ে না, তা খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরেও শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ার হার দিনদিন বাড়ছে।
২০১২ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধে নীতিমালা প্রণয়ন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২০১৯ সালে হাইকোর্টের আদেশে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না। তবে প্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বাধিক ১০ শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারেন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের নাম, রোল ও শ্রেণি সম্পর্কে প্রতিষ্ঠান প্রধানকে জানাতে হবে। তবে এখন পর্যন্ত এ নীতিমালা ঢাকাসহ দেশের কোথাও মানা হচ্ছে না।
কোচিং বাণিজ্য বন্ধে তদারকি করতে মেট্রোপলিটন ও বিভাগীয় এলাকার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারকে সভাপতি করে ৯ সদস্যের কমিটি থাকার কথা ছিল। জেলার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এবং উপজেলার ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সভাপতি করে আট সদস্যের কমিটি গঠনের কথা নীতিমালায় বলা হয়েছে। বাস্তবে এসব কমিটির কার্যকারিতা কোথাও দেখা যায় না। নীতিমালা অনুসারে এমপিওভুক্ত বা এমপিওবিহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত বা এমপিওবিহীন শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যে জড়িত থাকলে তার এমপিও স্থগিত, বাতিল, বেতনভাতা স্থগিত, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত, বেতন একধাপ অবনমিতকরণ, সাময়িক বরখাস্ত, চূড়ান্ত বরখাস্ত ইত্যাদি শাস্তি হতে পারে। তবে নীতিমালা প্রণয়নের পর কোচিং করানোর দায়ে একজন শিক্ষকের শাস্তি হয়েছে এমন উদাহরণ নেই।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিগত দিনে কোচিং বিষয়ে একপ্রকার চুপচাপ ছিল। নীতিমালা প্রণয়ন করেই তাদের দায়িত্ব শেষ। নীতিমালা বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) দীর্ঘদিন ধরে হাত গুটিয়ে বসে আছে। কর্মকর্তারা ব্যবস্থা নিতে জনবল সংকটের কথা বলে দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন। ফলে এই নীতিমালা ‘কাগুজে নীতিমালা’য় পরিণত হয়েছে।
সরকারি নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে, মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের মতো নামীদামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক শ্রেণির শিক্ষকরা রমরমা কোচিং বাণিজ্যে মেতে উঠেছেন। শিক্ষার্থীর কাছে কোচিং সেন্টারগুলো স্কুলের বিকল্প হয়ে উঠেছে। কিছু শিক্ষক কোচিং সেন্টারগুলোকে শ্রেণি কক্ষের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন। সেখানে শিক্ষার্থীদের কোচিং করতে বাধ্য করা হচ্ছে। কোচিং না করলে ক্লাসে কম নম্বর দেওয়ার অভিযোগ উঠছে। অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোনো শিক্ষক বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কোচিং সেন্টারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত হতে পারেন না। নিজে কোচিং সেন্টারের মালিক হতে পারেন না। শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে পড়তে উৎসাহিত, উদ্বুদ্ধ বা বাধ্য করতেও পারেন না। নীতিমালায় আরো বলা হয়েছে, অভিভাবকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠান প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ের আগে বা পরে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে পারেন।
চারিদিকে সংস্কারের রব উঠেছে। কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বড় সংস্কার দরকার। কারণ শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষাকে ক্লাসমুখী করতে হবে। শিক্ষকরা যাতে ক্লাসমুখী হন সে ব্যবস্থা করতে হবে। আইনের সঠিক প্রয়োগের পাশাপাশি শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও সামাজিক সম্মান-মর্যাদা বাড়াতে হবে। যাতে করে তরুণ মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় উৎসাহিত হন। সে পরিবেশ রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে।
আই.কে.জে/