ইলিয়াস কাঞ্চন ও বনশ্রী। ছবি: সংগৃহীত
‘সোহরাব-রুস্তম’ সিনেমায় ইলিয়াস কাঞ্চনের বিপরীতে অভিনয়ের জন্য আলোচিত চিত্রনায়িকা বনশ্রীর করুণ জীবনের অবসান হলো। শহুরে জীবনের চড়াই-উতরাই শেষে নিজ এলাকা মাদারীপুরের শিবচরে ফিরে যান তিনি। কিন্তু তার জীবনে জৌলুস দূরের কথা স্বচ্ছলতাও ছিল না।
নানা জায়গায় ঘুরে অবশেষে ঠাঁই পেয়েছিলেন আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘরে। অভাবের তাড়নায় কিছুদিন ভিক্ষাও করেছেন তিনি। মৃত্যুর কিছুদিন আগে দেশের বিত্তবান ও চলচ্চিত্র অঙ্গনের কাছে সহযোগিতা চাইলেও তেমন কোনো সাড়া পাননি বনশ্রী।
দীর্ঘদিন ধরে নানা জটিল রোগে ভুগছিলন তিনি, ভালো চিকিৎসাও জুটেনি। অবশেষে মঙ্গলবার (১৬ই সেপ্টেম্বর) দুপুরে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫৫ বছর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। সন্ধ্যার পর জানাজা শেষে উপজেলার পল্লী কুমেরপাড় মামা বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয় বলে বনশ্রীর ভগ্নিপতি আবুল বাশার নিশ্চিত করেছেন।
ধর্ম ত্যাগ করে বিয়ে করেছিলেন। বনশ্রীকে ভালোবেসে সংসার পেতেছিলেন। কিন্তু জীবনের কি করুণ পরিহাস, একদিন সেই স্বামীও ছেড়ে গিয়েছিলেন নায়িকা বনশ্রীকে। এরপর থেকেই মূলত কঠিন এক সংগ্রামের জীবনের মুখে পড়তে হয়েছিল তাকে। দীর্ঘদিনের সেই সংগ্রাম থামিয়ে বনশ্রী এখন জীবনের ওপারে পাড়ি জমিয়েছেন।
বনশ্রীর জীবনের পরতে পরতে গল্পের ছড়াছড়ি। সেসব গল্প যেমন মনকে খারাপ করে দেয়, তেমনি রোমাঞ্চকরও। একসময় ফুল বিক্রি থেকে শুরু করে বাসে হকারি পর্যন্ত করতে হয়েছে সংসার চালাতে। জানা যায়, বনশ্রীর পরিবারিক নাম সাহিনা আকতার। তিনি সুশ্রী ছিলেন কৈশোর থেকে। মাদারীপুর থেকে বাবার সঙ্গে ঢাকায় এসে মোহাম্মদপুরে পরিবারসহ থাকতে শুরু করেন বনশ্রী। এখানে তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কত ছেলে যে প্রেমে পড়েছে, সেই হিসাব নেই। তবে সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন শ্যামল নামের একজন। ১৯৯২ বা '৯৩ সালের ঘটনা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির এক ছাত্র বনশ্রীদের পাশের বাড়িতে থাকতেন। তার নাম ছিল শ্যামল কুমার কণ্ঠ। তিনি বনশ্রীকে ভালোবাসতেন। রোজ লিখতেন চিঠি। বনশ্রীর পাত্তা না পেয়ে গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করতে চাচ্ছিলেন। পরে সব জেনে শ্যামলের মা বনশ্রীর বাড়িতে গিয়ে তার বাবার হাতে ছেলেকে তুলে দেন ‘ছেলের মৃত্যুর চেয়ে মুসলমান ছেলে অনেক ভালো’ এই দাবি করে। সেদিনই শ্যামলের সঙ্গে বনশ্রীর বিয়ে হয়ে গেল। শ্যামল কুমার কণ্ঠ ধর্ম ও নাম বদলে হয়ে গেলেন মাসুদ চৌধুরী।
এত রোমান্টিক গল্পটাও এক সময় বিষাদের হয়ে গেল। যে মানুষ বনশ্রীকে পাওয়ার জন্য গায়ে আগুন দিয়ে মরতে চেয়েছিলেন, সেই মাসুদ একদিন বনশ্রীকে ফেলে চলে গেলেন। সঙ্গে নিয়ে গেলেন একমাত্র কন্যা শ্রাবন্তীকেও। কিন্তু কেন?
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিয়ের পর বনশ্রী নায়িকা হতে চাইলে স্বামী আপত্তি করেননি। বনশ্রীও সুযোগ পেয়ে যান। গর্ভে বাচ্চা নিয়ে শুটিং করেছেন। সবকিছুই ঠিক ছিল। কিন্তু তার প্রথম সিনেমা ‘সোহরাব রুস্তম’-এর প্রযোজক মোহাম্মদ ফারুক ঠাকুরের পাগলামির খেসারত দিতে হয়েছে বনশ্রীকে।
তিনি বনশ্রীর প্রতি অতিরিক্ত আগ্রহী ছিলেন। একসময় ফারুক জড়িয়ে যান খুনের মামলায়। গ্রেফতারও হন তিনি। আর তারপর থেকেই বনশ্রীর জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। খুনি প্রযোজকের বান্ধবী হিসেবে বনশ্রীর নাম আলোচনায় এলে তাকে ছেড়ে যান স্বামী মাসুদ।
এরপর একাকীত্ব আর অভাবের তাড়নায় করুণ জীবন কাটিয়ে গেছেন বনশ্রী। পরবর্তীতে আরেকটি বিয়ে করেছিলেন তিনি। সেই স্বামীও ছেড়ে যান তাকে। তবে রেখে যান একমাত্র পুত্র মেহেদি হাসানকে।
শিবচরের মাদবরেরচর ইউনিয়নের শিকদার কান্দি এলাকার বাবা মজিবুর রহমান মজনু শিকদার ও মা সবুরজান রিনার দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে বনশ্রী বড়। সাত বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে রাজধানী ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করেন তিনি।
১৯৯৪ সালে ‘সোহরাব রুস্তম’ সিনেমা দিয়ে রুপালি পর্দায় আবির্ভাব ঘটে বনশ্রীর। নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের বিপরীতে ছবিটি ব্যবসা সফল হয়। পরিচিতি পান বনশ্রী। এরপর আরও গোটা দশেক সিনেমায় অভিনয় করেন। নায়ক মান্না, আমিন খান, রুবেলের বিপরীতেও নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেন বনশ্রী। রুপালি পর্দার মতো জীবনও হয়ে ওঠে আলো ঝলমল। তবে আলো ঝলমলে দিন বেশি দিন টেকেনি।
শিবচর থানার পাঁচ্চর এলাকার একটি সরকারি গুচ্ছগ্রামের ছোট্ট ঘরেই ছিল তার শেষ আশ্রয়। রান্না করতে না পারায় মাঝে মধ্যেই প্রতিবেশীদের কাছে খাবার চাইতে হতো। ঢাকায় মামার কাছে থাকা একমাত্র ছেলেও মায়ের খোঁজখবর নিতেন না বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।
শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. ইব্রাহিম মিয়া বলেন, ‘পাঁচ দিন ধরে অসুস্থ অবস্থায় শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি ছিলেন বনশ্রী। হৃদরোগ, কিডনি জটিলতাসহ নানা রোগে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। মঙ্গলবার দুপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।’
এই চিকিৎসক আরো বলেন, ‘বনশ্রী একাই প্রায়ই হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নিতেন। গত ৯ তারিখ এসে ভর্তি হন। তার দেখাশোনার কেউ ছিল না। আমরা সমাজসেবা অফিসের মাধ্যমে অনুদানের ব্যবস্থা করেছিলাম।’
একসময় লাখো দর্শকের প্রিয় এই অভিনেত্রীর জীবনের শেষ অধ্যায় কেটেছে একাকীত্ব ও কষ্টে। চলচ্চিত্র অঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্রের এমন পরিণতি শুধু সিনেমাপ্রেমীদের নয়, সমগ্র সংস্কৃতি অঙ্গনের জন্যই এক বেদনাদায়ক অধ্যায় হয়ে থাকবে।
খবরটি শেয়ার করুন