ছবি: সংগৃহীত
রবি হক
মহাত্মা ফকির লালন সাঁই-এর গানে নানা তত্ত্বের অবতারণা করা হয়েছে। কামতত্ত্ব নিয়ে ফকির লালন সাঁই অনেক বাণী রচনা করেছেন। আর এসব বাণীতে তিনি কাম ও প্রেমের অপূর্ব মিলন ঘটানোর চেষ্টা করেছেন।
কাম ও প্রেম মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। একটি ছাড়া অপরটিকে কল্পনা করা যায় না। যদিও শুধু কামেতে জন্ম হয় প্রেমের অভিলাষ। ফকির লালন তার রচিত বাণীতে বলেছেন-
‘করি কমনে/ কেমনে সহজ শুদ্ধ প্রেম সাধন,
প্রেম সাধিতে ফাঁপড়ে উঠে কাম নদীর তুফান।’
সহজ, শুদ্ধ প্রেম সাধন করতে গেলে কাম নদীতে তুফানের সৃষ্টি হয়। সাধন জেনে তা বসে আনতে হয়, আর তা না হলে কামের ফাঁদে পা পড়ে মহাবিপদে পড়তে হয়। সহজ, শুদ্ধ প্রেম সাধনায় কামকে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে অনেকেই বিবেচনা করে থাকেন। অনেকে মনে করেন, কাম থাকলেই বুঝি প্রেমের বিনাশ ঘটে।
কিন্তু মহাত্মা লালন কোনো গানেই কাম থেকে দূরে সরিয়ে বা দমন করে সহজ প্রেম সাধনের কথা বলেননি। কেননা, কামকে কখনো দমন করা যায় না। কাম হচ্ছে ষড়রিপুর সবচেয়ে শক্তিশালী রিপু। আর রিপুকে দমন করা যায় না, বরং সাধনার দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা কেবল সম্ভব। কাম না থাকলে শুদ্ধ প্রেমের উদয় হয় না। তাই তো মহাত্মা ফকির লালন তার গানের একাংশে বলেছেন-
‘বলবো কি সেই প্রেমের কথা,
কাম হইয়াছে প্রেমের লতা,
কাম ছাড়া প্রেম যথা তথা,
না হয় সে আগমন।’
অর্থাৎ, কাম প্রেমের সাথে লতা-পাতার মতো আষ্টে-পিষ্টে জড়িয়ে আছে। তাই কামকে বাদ দিয়ে প্রেমের কথা ভাবা অসম্ভব। কেননা, কাম ছাড়া প্রেম লবণ ছাড়া তরকারির মতো, যার স্বাদ আস্বাদন অসম্ভব। আর কাম না থাকলে সহজ, শুদ্ধ প্রেমের আগমনও ঘটে না। সৃষ্টির আদি থেকেই প্রেমের সাথে কামের অস্তিত্ব জড়িয়ে ছিল, আর তা এখনো আছে এবং থাকবে এটাই চিরন্তন সত্য।
কামকে কোনো বাঁধনে আটকে রাখা যায় না। কাম তার স্বীয় গতিতে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়। আর তাই প্রেম রত্নধন বলে আমরা যা বুঝি, তা পাবার বাসনায় কামকে নিয়ন্ত্রণ না করে বাঁধতে চাইলে সাধন হবে না। সাঁইজি এ সম্পর্কে গানে আরও বলেছেন-
‘প্রেম রত্ন ধন পাবার আশে,
ত্রিবেণী ঘাট বাঁধলাম কষে,
কাম নদীর এক ধাক্কা এসে
ছুটে যায় বাঁধন ছাদন।’
অর্থাৎ, ত্রিবেণী (ইড়া-পিঙ্গলা-সুষুম্না) ঘাটে যতই বাঁধ দেবার চেষ্টা করি না কেন, তা সফলকাম হবার নয়। সাধারণত আমরা ত্রিবেণী বলতে তিন নদীর (গঙ্গা-যমুনা-স্বরসতী) সঙ্গমস্থলকে বিবেচনা করে থাকি। কিন্তু দেহ সাধনায় শ্বাসের গোপন পথ হিসেবে ত্রিবেণীর গুরুত্ব অনেক। আর কাম নদীর এক শক্তিশালী ধাক্কায় এই ত্রিবেণীর ঘাটের বাঁধন ছাদন সব যায় টুঁটে। আর তাই তো মহাত্মা লালন গানের শেষাংশে বলেছেন-
‘পরম গুরু প্রেম প্রকৃতি,
কাম গুরু হয় নিজ পতি,
কাম ছাড়া প্রেম হয় কি গতি
ভেবে কয় ফকির লালন।’
কাজেই, কাম থেকে দূরে নয় কিংবা কামের ঘরে কপাট দিয়ে নয়; বরং কামের মধ্যে থেকে কামের ঊর্ধ্বে বিচরণের মাধ্যমেই সহজ, শুদ্ধ প্রেম সাধনা সম্ভব।
আরএইচ/এইস.এস
কামতত্ত্ব
সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
খবরটি শেয়ার করুন