ছবি - সংগৃহীত
নিখিল মানখিন
বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে একটি হলো ‘পাংখোয়া’ জাতি। বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান এবং ভারতের মিজোরাম রাজ্যে তাদের বসবাস। তারা মূলত খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। তাদের মাঝে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বিদ্যমান। বাংলাদেশে বসবাসরত সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের মধ্যে পাংখোয়া অন্যতম। তাদের সমৃদ্ধ ভাষা ও সংস্কৃতি আজ বিলুপ্তির পথে। নিজস্ব ভাষা থাকলেও বর্ণমালা নেই।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং সুখবর ডটকমকে বলেন, বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের সার্বিক অবস্থা ভালো না। তার মধ্যে পাংখোয়াদের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা ব্যবস্থা আরও করুণ হয়ে পড়েছে। স্বাক্ষরতার হার ভালো হলেও উচ্চ শিক্ষিতের সংখ্যা খুব কম। তাদের অনেকে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের অস্তিত্ব আজ হুমকির পথে বলে জানান সঞ্জীব দ্রং।
বসবাস:
পাংখোয়া সম্প্রদায় পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী। পাহাড়ে অন্যান্য সম্প্রদায়ের চেয়ে এই জাতির জনসংখ্যা খুবই কম। তবে রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি উপজেলা এবং বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলায় পাংখোয়াদের বাস। ভারতের মিজোরাম রাজ্যে বিপুল সংখ্যক পাংখোয়া সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে।
ধর্ম:
আদিবাসী নেতা পল্লব চাকমা জানান, পাংখোয়াদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হলো বড়দিন বা ক্রিস্টমাস। বড়দিনে পাংখোপাড়া আনন্দে মুখর হয়ে উঠে। বড়দিন উপলক্ষে ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় গির্জায় সমবেত প্রার্থনা ও ক্রিস্টমাস ক্যারোল সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে বড়দিনের উৎসবের সূচনা হয়। রাতভর চলে পাংখোয়া ভাষায় কীর্তন। ভোরে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নেচে গেয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে পিঠা খেয়ে সবাই উৎসবের আনন্দ উপভোগ করে। পরে গির্জায় প্রার্থনা ও বড়দিনের সংগীত পরিবেশন হয়। পাংখোয়ারা পরস্পরের মধ্যে বড়দিনের শুভেচ্ছা বিনিময় ও হাসি-আনন্দের মধ্য দিয়ে আনন্দে মেতে উঠে। দুপুরে স্থানীয় মাঠে অতিথিদের উপস্থিতিতে কেক কাটার পর পাংখোয়া শিল্পীরা ঐতিহ্যবাহী ফুলনৃত্য ও বাঁশনৃত্য পরিবেশন করেন। বিপুল সংখ্যক অতিথি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করে থাকে।
সামাজিক রীতিনীতি:
রাঙ্গামাটির মাংলি পাংখোয়া সুখবর ডটকমকে বলেন, পাংখোয়া সম্প্রদায়ের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের গান ও নৃত্য। এই জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই জুম চাষ ও বন্যপ্রাণী শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। তারা বন্যপ্রাণী শিকারের পর বন্যপ্রাণীর মাথা বাড়ির সামনে ঝুলিয়ে রাখে। বাঘ, গয়াল প্রভৃতি বন্যপ্রাণী শিকার করতে পারলে তা বীরত্ব হিসেবে গণ্য হয়।
পাংখোয়া নারীরা পিতলের তৈরি বিভিন্ন কটিবন্ধ ব্যবহার করে থাকেন। পাংখোয়া নারীরা সাধারণত স্কার্ট কোমরে জড়িয়ে রাখার জন্য পিতলের রিং কটিবন্ধ হিসেবে ব্যবহার করেন। অনেক নারী ঘুঙুর জাতীয় শিকল আড়াআড়ি করে পরেন এবং মাথায় ও গলায় নক্সা করে পুঁতির মালা পরে থাকেন। পাংখোয়াদের মাঝে ঐতিহ্যবাহী সাজগোজের প্রচলন রয়েছে। তবে তারা ফ্যাশন অনুরাগী। পাংখোয়া নারীরা নিজস্ব রঙের থামি কাপড় পরার পাশাপাশি স্কার্ট ও ব্লাউজ পরে। অতীতে পাংখোয়া নারীরা পানিতে ছাই মিশিয়ে তা ছেঁকে পরিষ্কার পানি দিয়ে চুল ধোয়ার কাজে ব্যবহার করতেন। তারা এখন বিশেষ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রী ব্যবহার করে থাকেন।
পাংখোয়া পুরুষরা সাধারণত প্যান্ট, শার্ট পরিধান করে। তারা হাতে চুড়ি, কানফুল, চুলে ক্লিপ ও ফুল, মথুরা বা বন মোরগের পালক, রাজধনেশ ও ভিমরাজ পাখির পালক চুলের ঝুটিতে ফ্যাশন হিসেবে ব্যবহার করে। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হওযায় এখন তাদের সমাজে পশ্চিমা সংস্কৃতির সাজগোজ রয়েছে। প্রকৃতিগতভাবে পাংখোয়া সম্প্রদায় গান ও নৃত্যে পারদর্শী। ছোট থেকে তারা নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের আঙ্গিকে গান-বাজনা ও নৃত্য চর্চা করে। পাংখোয়া সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী বাঁশনৃত্য অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন ও জনপ্রিয়। বাজনার তালে তালে, তালের ঝংকারে, সুরের মুর্ছনায় ছন্দময় বাঁশের ফাঁকে ফাঁকে যখন তরুণীরা নৃত্য পরিবেশন করে তখন দর্শকের হৃদয়-মন আনন্দে ভরে উঠে।
পাংখোয়া সমাজে পিতাই পরিবারের প্রধান। পিতার মৃত্যুর পর পুত্রসন্তানরা পারিবারিক বিষয়-আশয়ের উত্তরাধিকারী হয়ে থাকে। গোত্রে বিভক্ত পাংখোয়া ও ভানজাঙ। গোত্রান্তরে বিয়েতে কোনও বাধা নেই। পরিণত বয়সে পিতামাতার মতামত অনুযায়ী ছেলে ও মেয়ের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। তাদের মধ্যে বাল্যবিবাহের প্রচলন নেই। তাদের সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ ও বিধবা বিবাহের প্রচলন রয়েছে। মৃতদেহ কবর দেওয়ার রীতি প্রচলিত।
অর্থনৈতিক ও শিক্ষা ব্যবস্থা:
অর্জুণ পাংখো সুখবর ডটকমকে বলেন, রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার দুর্গম এলাকায় আমাদের বসবাস। আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠীর বড় অংশ বাস করে প্রতিবেশী দেশ ভারতে। তবে বাংলাদেশকে ভালোবেসে নানা অভিযোগ সত্ত্বেও এখানে বসবাস করে যাচ্ছি আমরা। শত কষ্টের মাঝেও আপন চরিত্র ও সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের বসবাস। আদিবাসীদের মধ্যে পিছিয়ে পড়া আমাদের কথা বলতেও যেন বাধা। নিজেদের অধিকারের কথা বলতে গিয়েও যেন বারবার থমকে যেতে হয়। কিছুই করার নেই। পিছিয়ে পড়েছি, পেছনেই থাকতে হবে। কে শুনবে আমাদের কথা। আমরা পাংখোয়ারা জানি না আমাদের ভাগ্যে কী আছে। নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় যেন এক ধরনের যুদ্ধ করেই আমাদেরকে বাঁচতে হচ্ছে। তারপরও টিকে থাকা যেন দায় বলে জানান অর্জুন পাংখোয়া।
পাংখোয়া পাড়ার লাইতাত পাংখোয়া বলেন, রাঙামাটির দুর্গম বিলাইছড়ি উপজেলাটি সাড়ে সাতশ’ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে গঠিত। এ এলাকায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পাংখোয়া সম্প্রদায়ের বসবাস। রাঙামাটি জেলা জুড়ে তিন হাজার পাংখোয়া বসবাস করলেও বিলাইছড়ি উপজেলার তিন কোনিয়া মৌজার আওতাধীন তথা বিলাইছড়ি ইউনিয়নে পাংখোয়াদের নিয়ে গঠিত হয়েছে পাংখোয়া পাড়া। যেখানে দেড় হাজার পাংখোয়ার বসবাস। পাংখোয়া পাড়ার বাসিন্দাদের পানি, স্বাস্থ্য সেবা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংকট দীর্ঘদিনের। উপজেলা সদরের সঙ্গে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় তাদের পড়তে হচ্ছে চরম দুর্ভোগে।
এ এলাকায় রয়েছে একটি মাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রাথমিকে পাস করার পর লেখাপড়া চালাতে হলে যেতে হয় বিলাইছড়ি সদরে। নৌকায় পাড়ি দিতে হয় এক থেকে দেড় ঘণ্টার পথ। কাপ্তাই হ্রদের পানি শুকিয়ে গেলে অর্ধেক পথ হেঁটে, বাকি অর্ধেক নৌকায় চড়ে সদরে আসতে হয়। দরিদ্র পরিবারের অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা তাই প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোলেই ঝরে যায়। তাদের স্বাক্ষরতার হার ৮০ ভাগ। পাংখোয়া ভাষায় কথা বলার পাশাপাশি শুদ্ধ বাংলায়ও কথা বলতে পারদর্শী তারা। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী পাংখোয়ারা একটু আধটু ইংরেজিও বোঝে।
মাংলি পাংখোয়া বলেন, আমাদের গ্রামে একটি মাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরুনোর পর লেখাপড়া করার মতো অন্য কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই এখানে। নেই কোনো চিকিৎসা কেন্দ্রও। উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম পানি পথ। কোনো মানুষ অসুস্থ হলে এক থেকে দেড় ঘণ্টা পানি পথ পাড়ি দিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে চিকিৎসা করাতে হয়। হ্রদের পানি শুকিয়ে গেলে উপজেলা সদরে যাতায়াত করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই এ গ্রামে একটি উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।