ছবি: সংগৃহীত
‘আল্লাহ, তুই দেহিস’—জোর করে চুল কেটে দেওয়ার সময় এই মর্মস্পর্শী আর্তনাদ ছিল এক বয়োজ্যেষ্ঠ ফকিরের। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েক ব্যক্তি জোর করে এক বৃদ্ধের চুল কেটে দিচ্ছেন। ওই সময় বয়স্ক মানুষটি অনেকক্ষণ চেষ্টা করেন নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে। না পেরে শেষ পর্যন্ত অসহায় আত্মসমর্পণ করে তিনি এ কথা বলেন।
ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দা থানার কাশিগঞ্জ বাজার সংলগ্ন কোদালিয়া গ্রামের ষাটোর্ধ হালিম উদ্দিন আকন্দের সঙ্গে তিন মাস আগে এ ঘটনা ঘটে। তবে ঘটনাটি সম্প্রতি ভাইরাল হলে এটি আলোচনায় আসে।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, একজন বয়স্ক ফকির লাঠি ও ব্যাগ হাতে একটি দোকানের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তার মুখে দাড়ি এবং মাথায় ছিল জটা পাকানো লম্বা চুল। হঠাৎ তিনজন ব্যক্তি তাকে ধাওয়া করেন এবং জোর করে টেনে-হিঁচড়ে রাস্তার পাশে নিয়ে যান। তিনি নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি।
চুল কাটার সময় অসহায় বৃদ্ধটি বারবার আকুতি জানানোর পাশাপাশি কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেই মুহূর্তে তার ‘আল্লাহ, আল্লাহ তুই দেহিস’—এই আকুতি মানুষের হৃদয়কে নাড়া দেয়। তবে সেই তিন ব্যক্তি তার আর্তনাদে কর্ণপাত না করে জোরপূর্বক মাথার সব চুল কেটে দেন।
ভুক্তভোগী হালিম উদ্দিন স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, ঘটনার দিন সকালে তিনি স্থানীয় বাজারে চায়ের দোকানে বসেছিলেন। হঠাৎ কয়েকজন তাকে চা নাশতা খাওয়ার জন্য বলেন। তাতে রাজি না হওয়ায় তাকে বাইরে এনে ৩-৪ জন মিলে ট্রিমার দিয়ে চুল দাড়ি কেটে দেন।
কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি আরও বলেন, সিলেটের হযরত শাহজালালের মাজারে যাওয়ার পর থেকে তিনি কোনদিন চুল কাটেননি। তার চুলের বয়স ছিল আনুমানিক ৩০ বছর। হঠাৎ করেই এই ব্যক্তিরা জোর করে চুল কেটে দেওয়ায় তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছেন।
চুল কেটে দেওয়ার পর বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন বলেও জানান তিনি। বিশেষ করে হাত পাসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ব্যথাসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভোগছেন।
সেই ঘটনার শারীরিক ও মানসিক আঘাত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি বৃদ্ধ হালিম উদ্দিন। বাইরে বের হতে অস্বস্তি বোধ করেন।
তিনি বলেন, ‘হেই থাইক্কা আমি কামকাজ করতে পারি না, বাজারে আইতারি না, ঘরবৈঠক আমি। রোগী ঝাড়তে পারি না। আসকা মাইরা শইল বেহুঁশ হইয়া যায়, মাথাত পানি ঢালন লাগে (হঠাৎ হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়ে, মাথায় পানি ঢালতে হয়)।’
যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের বিচার চান কিনা এ বিষয়ে জানতে চাইলে হালিম উদ্দিন জানান, তাদের বিচার আল্লাহ করবে। সামাজিকভাবে আমি অনেক হেয় প্রতিপন্ন হয়েছি। সারা বিশ্বের লোক আমাকে দেখেছে। বিষয়টি নিয়ে আমি খুবই মর্মাহত হয়েছি।
স্থানীয় বাসিন্দা হাসিবুদ্দিন জুয়েল জানান, একটি হিউম্যানিটি সংস্থার কয়েকজন টুপি-দাড়িওয়ালা এসে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে হালিম উদ্দিনের লম্বা চুলদাড়ি কেটে দেন। এ সময় বাজারে শত শত লোক তাকিয়ে দেখছিলেন। কিন্তু কেউ তার সাহায্যে এগিয়ে আসেননি।
হালিমের বড় ছেলে হাবিব জানান, আমার বাবা দীর্ঘদিন যাবত চুল দাড়ি কাটেন না। এতে তার কোন সমস্যা হতো না। সম্প্রতি ঢাকা থেকে কিছু লোকজন এসে জোর করে তার জটলা চুল দাড়ি কেটে দেন। বর্তমানে তিনি লজ্জায় ঘর থেকে খুব একটা বের হন না। এছাড়াও শারীরিক ও মানসিকভাবে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনা ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ময়মনসিংহ জজ কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শাজাহান কবির বলেন, ময়মনসিংহের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং লোকশিল্পের ধারক-বাহক হালিম ফকিরের ওপর যে বর্বরোচিত ঘটনা ঘটেছে, তা অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং দুঃখজনক। সংস্কৃতিমনা যেকোনো মানুষের জন্য এটি গভীর উদ্বেগের বিষয়।
ময়মনসিংহ জেলার বাউল সমিতির সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম আসলাম বলেন, আইনের দৃষ্টিতে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর এভাবে কাউকে জোর করে হেনস্তা করা বা শারীরিক ও মানসিকভাবে আঘাত করা গুরুতর অপরাধ। এটি কেবল ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়, এটি মানুষের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী এবং সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টির অপপ্রয়াস।
এদিকে এক বিবৃতিতে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এই ঘটনাকে ‘সম্পূর্ণ অমানবিক, বেআইনি এবং সংবিধান ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন’ বলে উল্লেখ করেছে।
আসক জানায়, এই কাজ কেবল ভুক্তভোগীর মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতার লঙ্ঘন নয়, বরং এটি তার মর্যাদার ওপর সরাসরি আঘাত। এই ধরনের ঘটনা সমাজে ভীতি, আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করছে।
জে.এস/
খবরটি শেয়ার করুন