ছবি - সংগৃহীত
রবিউল হক
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারায় কুশান গানের পরিবেশনা কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট বিশেষ করে রাজবংশীদের মাঝে লক্ষ করা যায়। লোকনাট্য হিসেবে এদেশে কুশান গানের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। “মূলত কুশান গান হলো ধ্রুপদী মহাকাব্য রামায়ণ ও তার বিভিন্ন চরিত্রের মাহাত্ম প্রকাশক আখ্যান। কারো কারো মতে, ‘কুশীলব’ শব্দ থেকে কুশান শব্দটি উৎপন্ন। কুশীলব শব্দটি সংস্কৃতজাত যার অর্থ অভিনয়ের পাত্র-পাত্রী”।১
কুশান গান পরিবেশনার সময়: বর্তমানে খুব একটা প্রচলন না থাকলেও কুশান গান মূলত আয়োজন করা হতো গ্রাম-বাংলার বিভিন্ন উৎসব, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজার অনুষ্ঠান উপলক্ষে। কুশান গানের পরিবেশনা রাতে শুরু হয়ে কখনো কখনো সকাল পর্যন্ত পরিবেশিত হতো।
কুশান গানের দল ও বায়না: সাধারণত কুশান গানের দল ১৫ থেকে ২০ জন কিংবা কোনও কোনও ক্ষেত্রে এর বেশি সদস্য নিয়ে গঠিত হয়ে থাকে। গানের দলের ম্যানেজার পরিবেশনার পূর্বে সম্মানী হিসেবে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা ধার্য করেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে টাকার অংকটা একটু বেশি হয়ে থাকে। গ্রামের সাধারণ জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রয়াসে এর আয়োজন এক ভিন্ন মাত্রা তৈরি করতে সক্ষম হয়।
পরিবেশনার স্থান: কুশান গানের পরিবেশনা মূলত মন্দির প্রাঙ্গণ, বৃহৎ কোনও বটতলা, এমনকি বাড়ির উঠানেও আযোজন করা হয়ে থাকে।
আলোকসজ্জা: কুশান গান পরিবেশনার স্থানে পূর্বে হ্যারিকেন, হ্যাজাক বাতি ব্যবহার হলেও বর্তমানে বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবহার বেশ লক্ষণীয়।
সাজ-সজ্জার ঘর: পরিবেশনা যদি কোনও বাড়ির আঙ্গিনায় হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে বাড়ির কোনও একটি ঘর সাজঘর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অন্যথায় খোলা মাঠ বা মন্দির প্রাঙ্গনে কুশান গান পরিবেশিত হলে কুশীলবরা (অভিনয়ের পাত্র-পাত্রী) একবারেই সাজসজ্জা নিয়ে মঞ্চে বসে পড়েন।
কুশান গানের শিল্পীদের পরিচয়: কুশান গানের মূল গায়েনকে বলা হয় গিদাল। এছাড়া ছোকরা চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে ছেলেরা মেয়েদের পোশাক পরিধান করে অভিনয় করে থাকেন। আর মঞ্চে আনন্দমুখর ভাব ফুটিয়ে তোলেন ‘ভাড়’ চরিত্র।
কুশান গানে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র: কুশান গানে বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে হারমোনিয়াম, খোল, করতাল বা জুড়ি, বেহালা এবং দোতারা ব্যবহার করা হয়। তবে বেণা নামে একটি তারযন্ত্র কুশান গানের মূল বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
পোশাকের ব্যবহার: রামায়ণের কাহিনী অবলম্বন করে কুশান গানের পরিবেশনায় গিদাল সাদা ধুতি ও পাঞ্জাবি পরিধান করে একটা উত্তরীয় কাঁধে ঝুলিয়ে অভিনয় করেন। সীতা চরিত্রে রূপদানকারী অভিনেত্রী ও ছোকরাগণ উজ্জ্বল রঙের শাড়ি, ব্লাউজ পরিধান করে অভিনয় করেন। সাদা ধুতি ও হাফ হাতা গেঞ্জি পরিধান করে লব ও কুশ চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়।
পরিবেশনা রীতি: কুশান গানে সংলাপ, অভিনয় ও নৃত্য-গীতের মিশ্রণ থাকলেও মূলত তা বর্ণনাত্মক রীতির ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারা বলে বিবেচিত। গিদাল আসর বন্দনা দিয়ে শুরু করে রাম বন্দনা, দেব-দেবী বন্দনা, আসর ও দর্শক ভক্ত ইত্যাদি বন্দনা শেষ করে পালার নাম প্রকাশ করে থাকেন।
কুশান শিল্পীদের বর্তমান অবস্থা: এ দেশের কুড়িগ্রাম অঞ্চলে কুশান গানের শিল্পীদের খুব জনপ্রিয়তা ছিল। সারাদেশে তাদেরকে কুশান শিল্পী হিসেবে এক নামেই চিনতো। “বর্তমানে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলায় কয়েকজন জনপ্রিয় কুশানশিল্পী ঐতিহ্যবাহী এই ধারাকে আজও ধরে রেখেছেন”।২
তথ্যনির্দেশ
১. সাইমন জাকারিয়া, বাংলাদেশের লোকনাটক: বিষয় ও আঙ্গিক বৈচিত্র্য, বাঙলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০৮, পৃ.১৮৪
২. শামসুজ্জামান খান (সম্পা.), বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা: পঞ্চগড়, বাংলা একাডেমি, ২০১৩, পৃ. ১৭১-১৭২
রবিউল হক, লোক গবেষক ও শিল্পী
আই.কে.জে/