ছবি: সংগৃহীত
চলমান রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নিজ নিজ অবস্থান জানিয়েছে জাতীয় পার্টিকে (জাপা) নিষিদ্ধের প্রশ্নে। গতকাল রোববার (৩১শে আগস্ট) প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে তিন দলের সঙ্গে আলাদা বৈঠকে জুলাই সনদ, জাতীয় সংসদ নির্বাচন, গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নুরের ওপর হামলা ও জাপাকে নিষিদ্ধ করাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
জামায়াত ও এনসিপি জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত দিয়েছে। তবে বিএনপি বলেছে, তারা কোনো দলকে নিষিদ্ধের পক্ষে নয়। প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপি কেন জাপাকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধের পক্ষে নয়? এ ক্ষেত্রে বিএনপির রাজনৈতিক কৌশলটা আসলে কী? একইসঙ্গে প্রশ্ন, সরকার কি আদৌ জাতীয় পার্টিকে, বা দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করবে? হঠাৎ জামায়াত, এনপিপির এ রকম 'কড়া অবস্থানের' কারণ কী? রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, তিনটি দলেরই এমন অবস্থানের পেছনে রয়েছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন-কেন্দ্রিক নিজস্ব হিসাব-নিকাশ।
'জাপাকে শিগগিরই নিষিদ্ধ করা হতে পারে' বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাসুদ কামাল। তিনি বলেন, 'প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জামায়াত ও এনসিপি সরাসরি দাবি জানিয়েছে, জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হোক। আমার ধারণা, এই দাবি বাস্তবায়ন হবে এবং খুব শিগগিরই হবে। আবার না-ও হতে পারে, কিন্তু আমি যা বুঝেছি, তাতে মনে হচ্ছে, পরিস্থিতি বলছে, জাপাকে নিষিদ্ধ করা হবে। এর পেছনে আরেকটি কারণ আছে—নির্বাচনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।'
তিনি বলেন, 'যদি এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়—তাহলে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে বিএনপি, জামায়াত, জাপা, এনসিপি, এবি পার্টি, ইসলামী আন্দোলন এবং আরো কিছু বামপন্থী দল—যেমন সিপিবি (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি)। এনসিপি ও জামায়াতের তিনটি মূল দাবি রয়েছে—সংস্কার, সংবিধান সংশোধন এবং পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন। তারা পরিষ্কারভাবে জানিয়েছিল, যদি এই দাবিগুলো না মানা হয়, তাহলে তারা নির্বাচন বয়কট করবে। এনসিপি নির্বাচন বয়কট করলে তাতে তেমন কিছু আসে-যায় না। কারণ, তারা এখনো বড় দল নয়। কিন্তু জামায়াত বয়কট করলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।'
তার মতে, ''আওয়ামী লীগ এখন নির্বাচনের বাইরে। বিএনপি একা নির্বাচনে গেলে সেটা কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না। না দেশের, না আন্তর্জাতিক মহলের কাছে। জাপার উপস্থিতিতে নির্বাচনের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরির সুযোগ আছে। কিন্তু এখন যদি জাপার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয় বা নির্বাচনের বাইরে রাখা হয় দলটিকে, তাহলে নির্বাচনের ভার চলে যাবে জামায়াতের হাতে। তখন জামায়াত যদি বলে, 'নির্বাচন ছয় মাস পিছিয়ে না দিলে আমরা যাব না'—তাহলে কেউ কিছু বলতেও পারবে না। এ কারণেই জামায়াত ও এনসিপি এখন জাপাকক নিষিদ্ধ করার দাবিটা জোরেশোরে তুলছে।''
মাসুদ কামাল আরো বলেন, 'আমি আগে থেকেই বলে আসছি, নির্বাচন আসলে ফেব্রুয়ারিতে হবে নাকি আরো পরে হবে, সেটা নির্ভর করছে এসব কিছুর ওপর। প্রধান উপদেষ্টা বারবার বলেছেন, নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হবে। কিন্তু আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, যদি জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা যায়, তাহলে নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে (২০২৬ সালের) হবে না।'
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে গতকাল রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই বৈঠকে জাপাকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে জামায়াত ও এনসিপি। তবে বিএনপি নিষিদ্ধের বিষয়ে রাজি হয়নি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে—জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ হলে জামায়াত ও এনসিপির কী লাভ? আবার বিএনপিরই বা কী ক্ষতি? কেন বিএনপি এই প্রস্তাবে রাজি হচ্ছে না? জামায়াত ও এনসিপি কেন এত আগ্রহ নিয়ে এর পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে? আসলে লাভটা কার?'
তিনি বলেন, ''এখানে পুরো বিষয়টা যদি খতিয়ে দেখা যায়, তাহলে বোঝা যাবে—আসল ফোকাস পয়েন্টটা কোথায়। জামায়াত ও এনসিপির প্রধান ফোকাস নির্বাচন নয়। তারা এখন ব্যস্ত আছে ‘জুলাই সনদ’, সংস্কার, সংবিধান পরিবর্ধন, পরিমার্জন ইত্যাদি নিয়ে। তাদের আগ্রহ মূলত কাঠামোগত সংস্কারে। অন্যদিকে বিএনপির ফোকাস একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি নির্বাচিত সংসদ প্রতিষ্ঠা করা। এরপর সেই সংসদকে ব্যবহার করে ‘জুলাই সনদ’ কিংবা অন্যান্য বিষয় নিয়ে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োজন হলে সংবিধান সংশোধন করার পক্ষে তারা। এই জায়গায় এসে দেখা যাচ্ছে, ফোকাস পয়েন্টে দলগুলোর মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে।''
তিনি বলেন, 'জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব এসেছে জামায়াত ও এনসিপির পক্ষ থেকে। এ ছাড়া নির্বাচন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো—তাদের শীর্ষ নেতারা গণহত্যায় জড়িত। এই অভিযোগে মামলা হয়েছে, বিচার চলছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জাপার কয়জন নেতা এই ধরনের অভিযোগে অভিযুক্ত? জাপা কি ক্ষমতায় ছিল? তাহলে জাপার ইস্যুটাই বা এত গুরুত্ব পাচ্ছে কেন?
মোস্তফা ফিরোজ বলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি বিএনপি করেনি। জাতীয় পার্টিকে নিয়েও বিএনপি সে রকম দাবি করছে না। অথচ যদি আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ হয়, তাহলে বিএনপির তো খুশি হওয়ার কথা—বড় দল হিসেবে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। তাহলে কেন বিএনপি এসব দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষ নেয় না? কারণ, বিএনপি জানে—বাংলাদেশের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক মানদণ্ড অনুযায়ী সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনই হলো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। আওয়ামী লীগের সময় বিদেশিদের বক্তব্যও ছিল—সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয়।
জামায়াত ও এনসিপিকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আজ আপনি যাদের ফ্যাসিস্ট বলছেন, কাল আপনি যদি ক্ষমতায় গিয়ে ফ্যাসিস্ট আচরণ করেন, তখন আপনাকেও নিষিদ্ধ করার দাবি উঠবে। এই নিষিদ্ধের চক্র চলতেই থাকবে। এর চেয়ে ভালো—জনগণকে নির্ধারণ করতে দিন। ভোটে হারান। প্রোপাগান্ডা দিয়ে না, বাস্তব রাজনীতির মাঠে হারান। তাহলেই গণতন্ত্র টিকে থাকবে।
খবরটি শেয়ার করুন