জুলকারনাইন সায়ের সামি। ছবি: সংগৃহীত
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় নেতা। বিদেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেওয়ার সময় এখন তার না থাকারই কথা। বক্তৃতা দেওয়ার চেয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতৃত্ব দেওয়াটা তার জন্য বেশি জরুরি। একটি দেশের শীর্ষ কোনো নেতার ইতালির রাজধানী রোমে চলমান ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরামের ফ্ল্যাগশিপ ইভেন্টে যোগ দেওয়া আদৌ জরুরি কি না, এ প্রশ্ন তুলেছেন দেশের কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিকেরা। তারা বলছেন, রোমের ওই অনুষ্ঠানে সাধারণত কোনো দেশের মন্ত্রী ও সচিব পদমর্যাদার ব্যক্তিরা অংশ নিয়ে থাকেন।
তাছাড়া ড. ইউনূসের এবারের রোম সফর কোনোভাবেই ইতালি ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক নয়। দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক ছাড়া অন্যান্য সফর থেকে রাষ্ট্রের কোনো লাভ হয় না। তবে কখনো কখনো দুই রাষ্ট্রের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট নয়, এমন অনেক অনুষ্ঠানেও অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষদের যোগ দিতে দেখা যাচ্ছে। এতে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি ছাড়া লাভ হচ্ছে না। সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১৪ মাসে ১৫ বার বিশাল বহর নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিদেশ সফরের মধ্য দিয়ে দেশের অর্জন কী, এমন প্রশ্নও সামনে এনেছেন বিশেষজ্ঞেরা। খবর বিবিসি বাংলার।
এবারের সফরকালে ইতালির রাজধানীতে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও রোমের মেয়র রবার্তো গোয়ালতিয়েরি স্থানীয় সময় গতকাল সোমবার (১৩ই অক্টোবর) সাক্ষাৎ করেন। তাদের এই সাক্ষাৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আল-জাজিরার সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের সামি। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘প্রশ্ন হলো, কে কার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন এবং কোথায় করলেন? বাংলাদেশের সরকারপ্রধান ইতালির রোম শহরের মেয়রের অফিসে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলেন? নাকি রোম নগরীর মেয়র বাংলাদেশের সরকার প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তার হোটেল রুমে গেলেন?’
তিনি প্রশ্ন করে বলেন, ‘প্রটোকল কী বলে? একটি দেশের সরকারপ্রধান, তিনি সফর করছেন এমন আরেকটি দেশের শহরের মেয়রের অফিসে গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা কি গ্রহণযোগ্য বা যৌক্তিক?’ ওই পোস্টে দুটি ছবির মধ্যে তুলনা করে তিনি বলেন, ‘ছবিতে ইতালির রোম শহরের মেয়র রবার্তো গোয়ালতিয়েরির কার্যালয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান ড. ইউনূস এবং আরেকটি ছবিতে রোম শহরের মেয়র রবার্তো গোয়ালতিয়েরির অফিসে ডাবলিন শহরের মেয়র এমা ব্লাইন।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টারা নিয়মিত বিদেশ সফর করছেন। কখনো কখনো দুই রাষ্ট্রের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট নয় এমন অনেক অনুষ্ঠানেও যোগ দিতে দেখা গেছে তাদের। এ সরকারই গত ডিসেম্বরে উপদেষ্টা, বা সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ সংক্রান্ত ১৩ দফা বিশেষ নির্দেশ জারি করে। তবে সফরের ক্ষেত্রে সেগুলো মানা হচ্ছে না। গত আওয়ামী লীগের সরকারের আমলেও বিশাল বহর নিয়ে বিদেশ সফর, বা মন্ত্রী ও আমলাদের সফর নিয়েও নানা সমালোচনা হয়েছিল।
ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরামের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের ইতালির রোম সফর ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গত কয়েকদিন ধরে বেশ আলোচনা-সমালোচনা চলছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, উদ্বোধনী এই অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য দিয়েছেন ড. ইউনূস। গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিয়ে দেশে ফিরেন প্রধান উপদেষ্টা। আবার অক্টোবর মাসে রোম সফরে গেছেন। তার ঘনঘন সদলবলে বিদেশ সফর নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইতালি ও বাংলাদেশ- এই দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক কোনো সফর নয় এটি। ইতালির সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানের সাথেও বাংলাদেশের সরকার প্রধানের কোনো বৈঠকের তথ্য নেই। ফলে সরকারি অর্থ ব্যয় করে এ ধরনের একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সরকার প্রধানের যোগ দেওয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছেন নেটিজেনেরা। ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরামের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়, যুবশক্তি, বিজ্ঞান ও উদ্ভাবন এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে কৃষিখাদ্য ব্যবস্থাকে রূপান্তরিত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে এ ফোরাম।
২০২১ সাল থেকে ফোরামের এই অনুষ্ঠান শুরু হয়। এর আগের চারটি অনুষ্ঠানের তথ্যে দেখা যায়, ইভেন্টের বিভিন্ন সেশনে কয়েকটি দেশের কৃষি মন্ত্রী বা কৃষি সংক্রান্ত দফতরের কর্মকর্তারা যোগ দিয়েছেন। এই ফোরামের ২০২৪ সালের অনুষ্ঠানে শুধু একটি দেশের সর্বোচ্চ নেতা অংশ নিয়েছিলেন। লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট জোসেফ মিয়ুমা বোকাই ওই অনুষ্ঠানে সরাসরি উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেন।
রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসসে প্রধান উপদেষ্টার রোম সফর নিয়ে প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয়েছিল, তিনি সফরের সময় ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলানির সাথে সাক্ষাৎ করবেন। তবে এ সংবাদ পুরোপুরি ঠিক নয় জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। তিনি দাবি করেন, 'বাসস বা কোনো সংবাদপত্র এই সফর সম্পর্কে আমার সাথে কথা বলেনি।' তিনি দাবি করেন, এই সংবাদ সম্মেলনের সময় প্রধান উপদেষ্টা ইতালির প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করবেন, এমন কথা তিনি বলেননি।
চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ প্রশ্ন তুলেছেন, একটি দেশের শীর্ষ নেতার ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরামের ফ্ল্যাগশিপ ইভেন্টে অংশ নেয়াটা খুব জরুরি কিনা? তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, 'প্রধান উপদেষ্টা একটা মাল্টিলেটারাল বা বহুপাক্ষিক অনুষ্ঠানে গিয়েছেন। এটা ইতালি ও বাংলাদেশের মধ্যে একটা দ্বিপাক্ষিক সফর নয়। এটা নিয়ে মানুষ চিন্তিত।' সাবেক এই রাষ্ট্রদূত উল্লেখ করেন, প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক অনুষ্ঠান সত্যিকার অর্থে খুব কম হচ্ছে।
তার প্রশ্ন, 'ফলে এগুলোতে যাওয়া কি প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের জন্য খুব জরুরি? তার এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে।' কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের এই মুহূর্তে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা ছাড়া অন্য কোনো জরুরি কাজ আছে কিনা? এ প্রসঙ্গে সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, 'আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, প্রধান উপদেষ্টা এখন জাতীয় নেতা। বক্তৃতা দেওয়ার চেয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতৃত্ব দেওয়াটা তার জন্য বেশি জরুরি। তার সেই কাজটায় বারবার ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।'
ফয়েজ আহমদ বলেন, 'এ ধরনের অগুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ায় প্রধান উপদেষ্টার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে এবং যে প্রশ্নগুলো উঠছে, সেগুলোকে সিরিয়াসভাবে নিচ্ছেন না তিনি। তার সিরিয়াসনেসের অভাবটার কারণে নেগেটিভ একটা ইম্প্যাক্ট পড়ছে তার নিজের ওপরে আর সরকারের সক্ষমতার ওপরেও।'
খবরটি শেয়ার করুন