ছবি: সংগৃহীত
অন্তর্বর্তী সরকারের বিগত নয় মাসে দেশের বেসরকারি চারটি টিভি চ্যানেল ও একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার মিলিয়ে অন্তত দশজন সাংবাদিকের ‘উচ্চপর্যায়ের টেলিফোনে’ চাকরিচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলে সাংবাদিকদের অভিযোগ। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা, অন্তর্বর্তী উপদেষ্টা ও প্রভাবশালী নেতা বা গত বছরের গণ-অভ্যুত্থানের সময়ের সমন্বয়কের ‘টেলিফোনে’ তারা চাকরিচ্যুত হওয়ার অভিযোগ করছে সাংবাদিক সমাজের একাংশ। একই কারণে দীপ্ত টিভিতে চলতি সপ্তাহের একদিনের কয়েক ঘণ্টা সংবাদ অনুষ্ঠানের সম্প্রচার বন্ধ থাকে বলেও তাদের অভিযোগ।
গত ২৯শে এপ্রিল সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সংবাদ সম্মেলনে ‘জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে অবমাননাকর’ প্রশ্ন করার অভিযোগে তিনটি টিভি চ্যানেলের (দীপ্ত, এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই) তিনজনের চাকরিচ্যুত হওয়ার অভিযোগ উঠে। এর আগে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহর হুমকিতে সময় টিভির পাঁচজন এবং চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের ‘টেলিফোনে’ দৈনিক কালের কণ্ঠের দুই সাংবাদিকের চাকরি হারানোর অভিযোগ উঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
নতুন অভিযোগ এখন সামনে নিয়ে এসেছে পুরনো অভিযোগগুলোকে। এ নিয়ে সাংবাদিক সমাজের একাংশ ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা করছে সরকারের। সাংবাদিকের 'চাকরি খাওয়া' গণমাধ্যমের কন্ঠরোধের ভয়াল পন্থা বলে মনে করছেন তারা। তাদের দাবি, সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করে কোনো সাংবাদিকের চাকরি হারানোর ঘটনা দেশের প্রায় চুয়ান্ন বছরের সাংবাদিকতার ইতিহাসে, এমনকি সামরিক শাসনামলেও ঘটেনি। ২০২৪ সালের ৮ই আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার দিন থেকে সাংবাদিক নির্যাতন নতুন মাত্রা পেয়েছে।
দুঃখজনক হচ্ছে, বিষয়গুলো নিয়ে বিভক্ত সাংবাদিক সমাজের দুই অংশ ঐক্যবদ্ধভাবে আলোচনা-সমালোচনার বদলে তাদের মধ্যে বিতর্ক চলছে। নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের আমলে সুবিধা পাওয়া সাংবাদিক সমাজের একাংশের দাবি, এসব সাংবাদিক চাকরিচ্যুত হয়েছেন মালিকপক্ষের নিজস্ব সিদ্ধান্তে। আবার এ সরকারের আমলে সুবিধাবঞ্চিত ও এক ধরনের বেকায়দায় থাকা সাংবাদিকদের দাবি, সরকারের শীর্ষপর্যায়ের বা প্রভাবশালীদের 'হুমকিতে' অন্তত দশজন সাংবাদিক চাকরি হারিয়েছেন, যাদের ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। এর বাইরে এমন ঘটনা আছে, যা সেভাবে আলোচনায় আসেনি।
আসলেই কী উল্লেখিত সংবাদমাধ্যমগুলো থেকে দশজনের চাকরি গেছে প্রভাবশালী কারো ‘হুমকিতে’? তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওঠা এ অভিযোগগুলোর পুরোপুরি সত্যতা মিলছে না অনুসন্ধানে। অনুসন্ধান বলছে ভিন্ন কথা। কোথাও কোথাও অভিযোগের সঙ্গে অনুমাননির্ভর গুজবও জড়িত। সংস্কৃতি উপদেষ্টার সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করার জের ধরে মোট তিন সাংবাদিকের 'চাকরিচ্যুত' হওয়ার ঘটনায় ওই তিন টিভি চ্যানেলের কর্তৃপক্ষের কারো কাছে সরকারের কোনো পর্যায়, বা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে কোনো ধরনের নির্দেশ দেওয়া হয়নি। বিষয়টি সুখবর ডটকমকে নিশ্চিত করেছেন তিনটি টিভি চ্যানেলের শীর্ষ পর্যায়ের সাংবাদিক ও কর্মকর্তারা।
এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহী সম্পাদক মনিউর রহমান ও দীপ্ত টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক এস এম আকাশ নিশ্চিত করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের দুই সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করতে সরকারের প্রভাবশালী কেউ তাদের হুমকি দেননি, বা ফোন করেননি। ডয়চে ভেলে বলছে, 'অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টাকে প্রশ্ন করার পর তিন সাংবাদিক চাকরি হারিয়েছেন। তিন প্রতিষ্ঠানের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত মোব-সহিংসতার ভয়ে তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন তারা।'
জানা গেছে, ‘জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্স (জেআরএ)’ নামের একটি রাজনৈতিক ফেসবুক পেজ এক স্ট্যাটাসে সংস্কৃতি উপদেষ্টার সংবাদ সম্মেলনে ‘জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে অপেশাদারসুলভ’ প্রশ্ন করায় তিন সাংবাদিকদের নাম ও ছবি প্রকাশ করে, যেখানে তাদের ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের দালাল’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। তিন সাংবাদিককে তাদের মালিকপক্ষ চাকরিচ্যুত করে ওই 'ভয়ে'। এটা মালিকপক্ষের দুর্বলতা।
আগে 'রাষ্ট্রীয় সংস্থার মাধ্যমে' আগে গণমাধ্যমের ওপর যে হস্তক্ষপে করা হতো, ২০২৪ সালের ৫ই আগস্টের পর 'ইন্টারভেনশন থ্রু মোবোক্রেসি'র মাধ্যমে সেটি করা হচ্ছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সাইফুল আলম চৌধুরী।
অন্যদিকে সময় টেলিভিশনের পাঁচ সাংবাদিকের একসঙ্গে চাকরি যাওয়ার ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ সামনে আসে গত বছরের ডিসেম্বরে। চাকরিচ্যুত পাঁচজন চ্যানেলটির বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে ছিলেন। ওই সময় ফ্রান্সভিত্তিক সংবাদ সংস্থা এএফপি এ নিয়ে খবর প্রকাশের পর দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে।
অভিযোগ ওঠে, ২০২৪ সালের ১৮ই ডিসেম্বর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষনেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ কয়েকজনকে নিয়ে সময় টিভিতে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে দেখা করেন। টিভি স্টেশনের ১০ জনের নামের একটি তালিকা দিয়ে তাদের চাকরিচ্যুত করতে চাপ দেন। অন্তত ১৫ জনের একটি দলসহ হাসনাত আব্দুল্লাহ সিটি গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে কয়েকজনকে চাকরি থেকে বাদ দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়ার কথা বিবিসি বাংলাকে তখন নিশ্চিত করেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হাসান।
সিটি গ্রুপে যাওয়ার কথা স্বীকার করলেও সেখানে গিয়ে ভয় দেখানো বা তালিকা দেওয়ার অভিযোগ গণমাধ্যমের কাছে তখন অস্বীকার করেন হাসনাত আব্দুল্লাহ। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের জেরে 'চাকরিচ্যুত' করা হয় দৈনিক কালের কণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক হায়দার আলী ও নিজস্ব প্রতিবেদক সজিব ঘোষকে- এমন অভিযোগ করে সাংবাদিক সমাজের একাংশ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কালের কণ্ঠে শফিকুল আলমের বিরুদ্ধে ভূঁইফোড় সংগঠন 'মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের' একটি বিবৃতি নিয়ে প্রতিবেদন করায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিযোগ ওঠে।
প্রতিবেদনটি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের বিরুদ্ধে হওয়ায় সরকারের শীর্ষ মহলের টেলিফোনে কালের কণ্ঠ দু'জনকে চাকরিচ্যুত করে বলে অভিযোগ করা হয়। অনুসন্ধানে এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। হায়দার আলী এখনো কর্মরত আছেন কালের কণ্ঠে। সজীব ঘোষকে পত্রিকাটির সম্পাদক হাসান হাফিজ চাকরিচ্যুত করেননি। এমনকি মালিকপক্ষও নয়। তাকে চাকরিচ্যুত করেন হায়দার আলী। প্রেস সচিব শফিকুল আলমের বিরুদ্ধে তখন অপপ্রচার করে সাংবাদিক সমাজেরই একাংশ।
কালের কণ্ঠের অনেককে হায়দার এভাবে চাকরিচ্যুত করেন নিজের প্রভাব খাটিয়ে। ঠিক ওই সময় সজীবকে চাকরিচ্যুত করলে দায় বর্তাবে সরকারের ঘাড়ে, এমন চিন্তা থেকেই হায়দার তা করেন। এ বিষয়ে নানাভাবে চেষ্টা করেও হায়দার আলীর মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
এইচ.এস/