মঙ্গলবার, ১৭ই জুন ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩রা আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ

*** কেমন আছেন ইরানে আটকা পড়া বাংলাদেশিরা *** ওয়াশিংটনের একটি ফোনকলই নেতানিয়াহুকে থামাতে পারে: ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী *** রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের সুযোগ রেখে আইন সংশোধনে ফলকার টুর্কের উদ্বেগ *** এবার আয়াতুল্লাহ খামেনি সম্পর্কে যা বলছেন নেতানিয়াহু *** ইরান দ্রুত যুদ্ধবিরতি ও পরমাণু আলোচনায় ফিরতে চায় *** তিনটি সংসদ নির্বাচনের কর্মকর্তারা তদন্তের মুখে *** ইরানের এ পরিস্থিতি মেনে নিতে পারি না: ইসরায়েলের সাবেক মন্ত্রী *** ইরানে আটকা পড়া বাংলাদেশিদের জন্য হটলাইন চালু করল সরকার *** মধ্যপ্রাচ্যের পথে আমেরিকার রণতরি ইউএসএস নিমিটজ *** ইরানের সঙ্গে সব সীমান্ত বন্ধ করে দিল পাকিস্তান

‘ইরানের বর্তমান শাসকদের পতন চাই’

উপ-সম্পাদকীয়

🕒 প্রকাশ: ০৭:৪৩ অপরাহ্ন, ১৬ই জুন ২০২৫

#

ছবি: সংগৃহীত

পুলক ঘটক

বাংলাদেশ থেকে সাড়ে চার হাজার মাইল দূরবর্তী একটি দেশ ইরান। সে দেশের প্রতি আপনার অনুভূতির কেন্দ্রবিন্দু যদি হয় ‘ধর্মীয় বিশ্বাস’, তবে আমার সঙ্গে এর সম্পর্ক কি? আমি তো ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করি না। ধর্মের ব্যাপার হলে ইরানের সঙ্গে পৃথিবীর অন্যান্য অমুসলিম দেশ ও জনগণের অনুভূতির ভিত্তি কি হবে?

কথাটা সবার বোঝার জন্য বলছি। যখন ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে আপনি মানবিক ও অন্যান্য সম্পর্কগুলো নির্ধারণ করবেন, তখন এ প্রশ্ন নিয়েও আপনাকে ভাবতে হবে। 

ইসরায়েলের ১৮ দশমিক ১ শতাংশ নাগরিক মুসলমান (বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নাগরিকের সংখ্যা এর তুলনায় অনেক কম)। গত শুক্রবারের (১৩ই জুন) পর থেকে ইরানের হামলায় এখন পর্যন্ত ১৪ জন ইসরায়েলি নাগরিক নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্তত চারজন ফিলিস্তিনি মুসলমান বলে নিশ্চিত করা হয়েছে। বলুন তো, এ মুসলমান ইসরায়েলিরা এখন ইসরায়েলকেই সমর্থন করবে, না কি ইরানকে? ধর্ম, রাষ্ট্র এবং এর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক মিলিয়ে নিন। 

শিয়া শাসিত ইরানে প্রায় ১০ শতাংশ সংখ্যালঘু সুন্নি ছাড়াও কিছু খ্রিস্টান, জরথুষ্ট্রীয়, ইহুদি, বারহাই, মানদায়ান এবং ইয়াসানির মতো সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ রয়েছেন। ধর্ম বা সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে অনুভূতি নির্ধারণ হলে বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা কোন দিকে অবস্থান নেবেন? 

মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে না চাইলে ইরান বর্তমানে ‘মানুষের দেশ’ নয়–এটি শিয়াদের কর্তৃত্বে চালিত দেশ। সেখানকার রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি এ রকমই। ফলে সেখানে সংখ্যালঘু সুন্নিদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। তেহরানে সরকার অনুমোদিত কোনো সুন্নি মসজিদ নেই। সামরিক বাহিনী, বিচার বিভাগ, প্রশাসনিক উচ্চপদে সুন্নিরা অংশ নিতে পারেন না; তাদের ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সীমিত; কখনো কখনো বন্ধও করা হয়।

একাধারে তারা জাতিগত সংখ্যালঘু (বেলুচ, কুর্দ, তুর্কমেন) হওয়ায় দারিদ্র্য ও নিরাপত্তাহীনতা দ্বিগুণ। তাদের জীবনধারণের উপর তদারকি, গ্রেপ্তার এবং ধর্মচর্চায় নিয়ন্ত্রণ নিয়মিত। 

সুন্নিদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে ইহুদিরা সেখানে ভালো আছেন। অতি অল্পসংখ্যক ইহুদি থাকলেও তাদের সরকারি স্বীকৃতি আছে এবং পার্লামেন্টে ১টি আসন নির্ধারিত আছে তাদের জন্য। তেহরানে সিনাগগ (ইহুদিদের উপাসনালয়) ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। 

পৃথিবীতে পুরাতন মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ পীঠস্থান গণনা করলে পারস্য (সাবেক ইরান) তার একটি। ইরানের মতো সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতি পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। সেই দেশটি এখন মানুষের দেশ নয় –একটি সম্প্রদায়ের দেশ! 

১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর প্রথম দফায় কমিউনিস্টদের তুদেহ পার্টিসহ বিভিন্ন বিরোধী দল ও মতের অন্তত ৯ হাজার মানুষকে ইরানের শিয়া জেহাদিরা হত্যা করেছিলেন। বিপুল সংখ্যক মানুষ পালিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তখন আশ্রয় নেন।

সেই বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় ১৯৮৮ সালে অন্তত ৩০ হাজার রাজনৈতিক বন্দীকে হত্যা করা হয়েছে, যাদের মধ্যে বড় অংশ কমিউনিস্ট ও বামকর্মী। বলুন দেখি, সেই নিহতদের পরিবার-পরিজন ও দেশান্তরী হওয়া ইরানিরা কোন পক্ষ নেবেন? মানুষের অনুভূতি কি শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসনির্ভর? 

১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবে ক্ষমতা হারানো মোহাম্মদ রেজা শাহ পেহলভি পলাতক জীবনে থেকে ১৯৯০ সালে আমেরিকায় মারা যান। তার শাহবানা, উত্তরাধিকারী এবং বাকি পরিবার চলমান ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে প্রকাশ্যে ইরানের বর্তমান শাসকদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। প্রবাসী সাবেক ‘যুবরাজ’ রেজা পেহলভি এ যুদ্ধে ইরানের শিয়া শাসকদের উৎখাতের জন্য পশ্চিমাদের সহায়তা চেয়েছেন। 

একটি দেশের প্রতি নাগরিকদের সমর্থন কত প্রকার অনুভূতি ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট হতে পারে, চিন্তা করে দেখুন। এ কী শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসনির্ভর বিষয়? ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে সমর্থন চাইলে তো শুধু ইসলামি শিয়া-বিশ্বাসী দেশ অথবা ইসলাম বিশ্বাসী মানুষ ছাড়া বাকি পৃথিবীর সবাইকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পাওয়া আপনার স্বাভাবিক নিয়তি।

আমি আমার নিজের কথা বলি। অবস্থানগত, রাজনৈতিক মত, ধর্মীয় বিশ্বাস, সংস্কৃতি — ইত্যাদির কোনো ক্ষেত্রেই ইরানের শাসকদের সঙ্গে আমার নৈকট্যবোধ নেই। সাধারণ মানব-বোধের বাইরে আর কোন কোন বিষয় ইরান অথবা ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনের ক্ষেত্রে আমার অনুভূতিকে তাড়িত করতে পারে? 

এখন থেকে মাত্র তিন বছর আগে ২০২২ সালে নারী-মুক্তি ও গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করার কারণে ইরানে অন্তত ৬০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে –যার মধ্যে অন্তত ৬৩ জন নারী ও ৪৭ জন কিশোরী রয়েছেন। নারী আন্দোলনে সম্পৃক্ত মজিদ রেজা রহমান ভর্ড নামে ২৩ বছর বয়সী এক তরুণকে প্রকাশ্যে ক্রেনে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। ‘আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধে’র অভিযোগে এক দিনের মধ্যে তার বিচার ও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে ইরানের বিপ্লবী সরকার। 

আমি নারী-আন্দোলনের একজন উচ্চকণ্ঠ কর্মী। আমি ইরানের হলে হয়তো এভাবে ফাঁসিতে ঝুলতাম। পোশাকের কারণে মাহশা আমিনির হত্যা আমার হৃদয়বোধকে তাড়িত করে। আন্দোলনে গিয়ে ফাঁসিতে ঝোলা মানুষগুলোকে আমি সহযোদ্ধা অনুভব করি। আর ইরানের শিয়া শাসকদের আমি ‘কাতেল’ হিসেবে দেখি। 

ইসরায়েল আমার কাছে ব্যাপার নয়; পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের সহযোগিতায় আমি ইরানের বর্তমান শাসকদের পতন চাই। সেই মহান পারস্যের নবউত্থান দেখতে চাই –অবশ্যই তা ধর্মনিরপেক্ষ উত্থান; মানুষের উত্থান। 

আপনি ধর্মীয় বিশ্বাস বা সম্প্রদায়গত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বর্তমান ইরানের পক্ষে থাকতে চাইলে সেটা আপনার ব্যাপার –অন্যদের কাছে আশা করা উচিত নয়। জয় মানুষ।

লেখক: সাংবাদিক নেতা।

পুলক ঘটক

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন