ছবি: সংগৃহীত
মুক্ত সাংবাদিকতার চর্চা ধ্বংস করে দেশে কর্তৃত্ব-ফ্যাসিবাদ বিকাশ হওয়ার নেপথ্যে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকাও কম দায়ী নয় বলে বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ। গত বছরের ৫ই আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কর্তৃত্ববাদ ও স্বৈরতন্ত্রের পতন হলেও স্বাধীন সাংবাদিকতা চর্চায় এখনো সেই বাধা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাটেনি বলে কারো কারো অভিযোগ। সেজন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কোথাও কোথাও সংস্কারের দাবি জানাচ্ছেন তারা।
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালনে গতকাল রোববার (৪ঠা মে) ঢাকায় আয়োজিত একাধিক আলোচনা অনুষ্ঠানে উঠে আসে কোনো কোনো গোয়েন্দা সংস্থার চাপে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রায় সময় স্বাধীন সাংবাদিকতা করতে না পারার কথা। তাদের চাপের কথা সাংবাদিক ও প্রচারমাধ্যমের মালিকের বক্তব্যে উঠে আসে। আলোচনা সভাগুলোতে অংশ নেওয়া দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোতে সংস্কারের কথা বলেন। প্রশ্ন উঠেছে, মুক্ত সাংবাদিকতায় কোনো গোয়েন্দা কী সংস্থা এখনো বাধা দেয়? কতটা বাধা আসে?
অভিযোগ আছে, সামরিক ও বেসামরিক উভয় সরকারের আমলে রাজনৈতিক স্বার্থে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে মুক্ত সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। সবশেষ শেখ হাসিনার শাসনামলে এটি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। সাংবাদিকদের ভয় দেখানো ও নির্যাতন করতে গোয়েন্দাদের ব্যবহার করা হতো তখন। সংবাদমাধ্যমে সরকারি বিজ্ঞাপন অংশত বন্ধ করতে ও বিজ্ঞাপন না দিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে গোয়েন্দা সংস্থার চাপ দেওয়ার অভিযোগ ২০২০ সালে আমেরিকার মানবাধিকার প্রতিবেদনেও উল্লেখ ছিল। তবে বিষয়টি নিয়ে এবারের মতো এমন মুক্ত আলোচনা অতীতে তেমন হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বিষয়টি নিয়ে এভাবে প্রকাশ্যে মুক্ত আলোচনাকে 'গণমাধ্যমের স্বাধীনতা' হিসেবে দেখছেন অভিজ্ঞরা।
দেশে সংবাদমাধ্যম কেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি, সেই ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কিছু সরকারি এজেন্সির ‘চাপ’ এবং কালো টাকাওয়ালা কিছু ব্যবসায়ীর ‘আক্রমণের’ কথা রোববার এক অনুষ্ঠানে বলেন দৈনিক সমকাল ও চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের মালিক একে আজাদ। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে সংবাদ প্রকাশে অনেক সংস্থা ডমিনেট করে। এজন্য সংবাদ প্রকাশ করা যায় না।’
তিনি বলেন, ‘কারা আমাদের পত্রিকা ডমিনেট করে, কেন আমরা সত্য প্রকাশ করতে পারি না? প্রথম কথা হলো- তথ্য মন্ত্রণালয় কার্যকর না। কারা আমাদের নিউজ করতে বাধা দেয়? সরকারের বিভিন্ন সিক্রেট এজেন্সি। দে ডিকটেট আজ হুইচ নিউজ উইল বি পাবলিশড, হুইচ নিউজ উইল নট বি পাবলিশড।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান একই অনুষ্ঠানে বলেন, ‘মুক্ত সাংবাদিকতা, মানুষের অধিকার ও গণতান্ত্রিক চর্চা ধ্বংস করে কর্তৃত্ববাদ বিকাশ হওয়ার নেপথ্যে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দায়ী। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সংস্কার নিয়ে কেউ কথা বলেন না। সংস্থাগুলোতে এখন কিছু ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে। বাস্তবে কোথাও চর্চার পরিবর্তন হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘দেশে গোয়েন্দা সংস্থার প্রয়োজন আছে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রয়োজন আছে। সেটার দায়িত্ব তাদের। তবে তাদের এখতিয়ার বুঝতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং পরবর্তী সময়ে যে সরকার আসবে, তাদেরও বুঝতে হবে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ম্যান্ডেট (কাজ) কী এবং সেভাবেই তাদের কার্যক্রমকে সংজ্ঞায়িত করতে হবে।’
ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম তার সাম্প্রতিক এক কলামে লেখেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে ‘ডিজিএফআইকে ব্যবহার করে স্বাধীন ও মুক্ত গণমাধ্যমকেও ভয় দেখানো হয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দ্য ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন না দিতে বাধ্য করা হয় শেখ হাসিনার সরকারের নির্দেশে। এ অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা ২০১৬ সাল থেকে টানা আট বছর বহাল ছিল।’
তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো বিস্মিত হয়ে দেখেছে যে, সাংবাদিক সংস্থাগুলোর—যেমন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ), ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে), ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে), প্রেসক্লাব—নির্বাচনে কারচুপি করার পাশাপাশি টেলিভেশন টকশোতে কারা অংশ নেবেন, সেটাও বাছাই করে দিয়েছে ডিজিএফআই।’
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক সাইফুল আলম চৌধুরী মনে করেন, 'দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অটোক্রেসির হাত থেকে এসে মবোক্রেসির দৌরাত্ম্যে পড়েছে। আগে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করত, এখন মব তৈরি করে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। মবের মাধ্যমে গণমাধ্যমকে ভয় দেখানো হচ্ছে। সরকার সেটি দেখেও না দেখার ভান করছে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান ও বিবিসির সাবেক সাংবাদিক কামাল আহমেদ মনে করেন, ‘আগে (শেখ হাসিনার শাসনামলে) বার্তাকক্ষের লোকজন টেলিফোন পেতেন, তাদের ডেকে নেওয়া হতো কিংবা কোন সংবাদের কী শিরোনাম হবে, তা বলে দেওয়া হতো। এখন আর সেটি হয় না বলেই আমরা জানি। এটাই পার্থক্য।‘
তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এখন অনলাইনে কোনো কোনো গোষ্ঠী কিংবা জুলাই বিপ্লবের চেতনার কথা বলে কেউ কেউ পত্রিকা বা টেলিভিশনকে লক্ষ্য করে কথা বলেন। ফলে ওই পত্রিকা বা টেলিভিশনে মবের আশঙ্কা তৈরি হয় এবং সেই আশঙ্কা থেকে সেলফ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি চলে আসছে। এ শঙ্কা বা আশঙ্কা এখনো থাকা দুঃখজনক। এর বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের সাহসী হতে হবে এবং সরকারকেও এগুলো বন্ধের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।’
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গত ১৭ই জানুয়ারি সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিগত সময়ে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করার পেছনে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অন্যতম বড় ভূমিকা ছিল। সেই জায়গা থেকে সরে আসতে হবে। ভবিষ্যতে গণমাধ্যমে যাতে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো হস্তক্ষেপ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।’
মাহফুজ আনাম মনে করেন, ‘বিশ্বজুড়ে এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে, যেখানে শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সংসদীয় বা স্বাধীন তদারকি সংস্থার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হয়। ডিজিএফআই, এনএসআই, এসবি ও ডিবিসহ সব গোয়েন্দা সংস্থা এমন তদারকির আওতায় এলে তারা দলীয় স্বার্থের পরিবর্তে জাতীয় স্বার্থে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে।’
তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, একটি সুস্পষ্ট প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করতে হবে, যেখানে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কার্যপরিধি ও জবাবদিহিতার বিষয়গুলো সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা থাকবে। এতে করে প্রতিটি সংস্থা ও তাদের কর্মকর্তারা বুঝতে পারবেন যে, কোন কাজটি তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে এবং কোনটি পড়ে না।’
এইচ.এস/
খবরটি শেয়ার করুন