ছবি: সংগৃহীত
৬১ হিজরির ১০ মহররম ঐতিহাসিক কারবালার ঘটনা ঘটে। আজ প্রায় দেড় হাজার বছর পরও মুসলমানরা কারবালার নায়ক ইমাম হোসাইন (আ.) কে নানাভাবে স্মরণ করে।
কারবালার ঐতিহাসিক তাপর্য, প্রেক্ষাপট এবং শিক্ষা নিয়ে বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান।
কারবালার ঐতিহাসিক তাৎপর্য
এ পর্যন্ত সমাজ-সভ্যতা-ধর্ম-রাষ্ট্র-উত্থান-পতন ইত্যাদি নিয়ে যেসব ইতিহাস মানুষ লিখেছে আমার কাছে মনে হয় কারবালার ইতিহাস অন্য সব ইতিহাসের চেয়ে ব্যতিক্রম। কারবালা এমন এক ঘটনা যা শুধু মুসলমানদের হৃদয়ই নাড়া দিয়ে থেমে থাকেনি বরং চিন্তাশীল প্রতিটি মানুষকেই আলোড়িত-আবেগাপ্লুত করেছে, করছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত করবে।
৬১ হিজিরিতে কারবালার নির্মমতার সাক্ষী হয় দুনিয়া। তখন থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে মহররম মাস এলেই আহলে বাইত প্রেমিকরা নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকাশ্যে-গোপনে কারবালাকে স্মরণ করে। আমরা যেভাবেই কারবালাকে দেখি না কেন পৃথিবীর কাছে কারবালা একটি ইতিহাস।
কারবালাসহ সব ইতিহাসই বিশেষ করে দুই শ্রেণির মানুষের হাতে নির্যাতিত-নিষ্পেষিত হয়েছে। শাসকরা সব সময় চেয়েছে ইতিহাসের মহাসত্য যেন মুছে যায়। আর সুবিধাভোগী নামকাওয়াস্তে ধার্মিকরা চেয়েছে নিরেট সত্যের বদলে মিথ্যা দিয়ে জনসাধারণকে ভুলিয়ে নিজেদের পকেট ভারী করতে। কারবালার ইতিহাসও এ দুই শ্রেণির নিষ্পেষণের শিকার হয়ে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে।
কারবালা কেন ঘটেছে? কেনই বা নবির নাতিসহ নবি পরিবারের ৭২ সদস্যকে নির্মমভাবে শহিদ করা হলো?
রাসূল (সা.)-এর ওফাতের পর খোলাফায়ে রাশেদিনের চারজন যেভাবে নবিজির আদর্শে শান্তি-সম্প্রীতিতে ভরপুর রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন, ইয়াজিদের মাধ্যমে ইসলামের সে শাশ্বত খেলাফত ব্যবস্থা টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ইসলামি খেলাফতের নেতৃত্বের মানদণ্ড ছিল তাকওয়া।
যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি তাকওয়াবান, তিনিই নেতৃত্বের বেশি হকদার-এ নীতি ভূলুণ্ঠিত হয়েছে ইয়াজিদের ক্ষমতারোহণের মাধ্যমে। ইয়াজিদের শাসনের দুই বছরে শুধু যে কারবালার ঘটনা ঘটেছে তাই নয়, কুরআনের অসংখ্য অনুলিপি নষ্ট করা হয়েছে। কাবাঘরে গোলাবর্ষণ করা হয়েছে। রাসূল (সা.)-এর রওজা মোবারককে উটের আস্তাবলে পরিণত করা হয়েছে।
মক্কা-মদিনায় হাজার হাজার নারীর ইজ্জত লুণ্ঠন করা হয়েছে। আহলে বাইতের সদস্য যারা লুকিয়ে ছিলেন তাদের খুঁজে খুঁজে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। বহু সাহাবির স্মৃতিচিহ্ন নষ্ট করা হয়েছে। এসব কেন হয়েছে? দীর্ঘ দিনের হাশেমি ও উমাইয়া বংশগত দ্বন্দ্বের ফলে উমাইয়ারা যে মনস্তাত্ত্বিক হীনমন্যতা থেকে জুলুমের কারিগর হয়ে উঠেছিল, কারবালার নির্মম হত্যাকাণ্ড তারই প্রতিফলন। আমাদের প্রিয় নবি (সা.) ছিলেন হাশেমি।
এ কারণে উমাইয়ারা নবিজিকে সত্য জেনেও মেনে নিতে পারেনি। মূলত নবুওয়াতের ঘোষণার পর থেকেই উমাইয়াদের জোর প্রচেষ্টা ছিল মুহাম্মাদকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। কিন্তু কোথাও সফল হতে পারেনি। কয়েক দশক পর যখন কারবালায় ইমাম হোসাইনের কাটা মাথা ইয়াজিদের সামনে রাখা হয়েছে ইয়াজিদ তখন কবিতা আবৃতি করে বলেছে-বদরে আমার পূর্বপুরুষদের হত্যার প্রতিশোধ নিলাম মুহাম্মাদের নাতিকে হত্যা করে।
ইয়াজিদসহ উমাইয়া শাসকদের চরিত্র ঐতিহাসিকদের সামনে আছে, আবার আহলে বাইতের তাকওয়াভিত্তিকও জীবনাদর্শও ঐতিহাসিকরা আমাদের সামনে বলে গিয়েছেন। ইয়াজিদের চরিত্র আর হোসাইনের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।
পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিকসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইয়াজিদ ছিল বেপোরোয়া, খোদাদ্রোহী; অন্যদিকে হোসাইন (আ.) ছিলেন তাকওয়ার মূর্ত প্রতীক। সুতরাং কারবালার ইতিহাস যখনই কেউ বিকৃত করতে চেয়েছে, তাদের চেষ্টা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও হোসাইন (আ.) কেন কারবালায় গেলেন? তখন তার চেয়েও বড় সাহাবিরা জীবিত ছিলেন এবং তাকে কারবালায় যেতে বারণ করেছেন। এ বিষয়ে কী বলবেন?
ওই সময় দুনিয়ায় ইমাম হোসাইনের চেয়েও মর্তবায় বড় কোনো সাহাবি ছিলেন এ কথাটি শুদ্ধ নয়। আপনি বলতে পারেন বয়োজ্যেষ্ঠ সাহাবি ছিলেন। বয়সে বড় হলেই কেউ মর্যাদায় বড় হয়ে যায় না। ইবাদতে, তাকওয়ায়, চরিত্রে ইমাম হোসাইন শ্রেষ্ঠ ছিলেন। আবার বংশীয় দিক থেকে তিনি রাসূলের নাতি। এ দিক থেকেও শ্রেষ্ঠ ছিলেন।
শ্রেষ্ঠ হওয়ার কারণেই তিনি নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও কারবালার দিকে পা বাড়িয়েছেন। এ তো গেল আধ্যাত্মিক কারণ। বাস্তবিক আরেকটা কারণও ছিল। কুফার লোকজন চিঠির পর চিঠি পাঠিয়ে ইমাম হোসাইনকে বায়াতের জন্য আহ্বান জানাচ্ছিলেন। তখন যদি তিনি কারও পরামর্শে বা নিজের বুদ্ধিতে কুফায় রওনা না হতেন তাহলে কী হতো ভাবুন? হোসাইনের চুপ থাকায় ইয়াজিদি সাম্রাজ্য বিস্তার পেয়েছে এ কথাই ইতিহাসে লিখতে হতো।
তা ছাড়া কেয়ামতের দিন নবিজিকেই বা কী জবাব দিতেন ইমাম হোসাইন (আ.)। এসব কারণেই তিনি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছেন চুপ থাকার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়। তাই তিনি নির্ভিকচিত্তে কারবালায় শহিদ হন এবং ইতিহাসে সত্য প্রতিষ্ঠার নায়ক হয়ে চিরকাল বেঁচে থাকেন।
আরো পড়ুন: পবিত্র আশুরার ইতিহাস, তাৎপর্য ও করণীয়
কেউ আহলে বাইত, কারবালা এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বললে তাকে শিয়া অপবাদ দেওয়াটা কোনো ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্রের অংশ বলে মনে করেন?
এটা তখনো ছিল এখনো আছে। যারাই আলী (আ.) -এর পক্ষে ছিল, আহলে বাইতের পক্ষে ছিল তাদের শিয়া বলে জনবিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। খাসায়েসে আলী কিতাব লেখার কারণে ইমাম নাসায়িকে শিয়া অপবাদ দিয়ে পিটিয়ে মেরেই ফেলেছে।
আহলে বাইতের পক্ষে থাকার কারণে ইমাম শাফেয়িকে রাফেজি, শিয়া বলে গালি দেওয়া হয়েছে। ইমাম আজম আবু হানিফাকে গালি দেওয়া হয়েছে। তারপরও মানুষকে আহলে বাইত থেকে, কারবালার চর্চা থেকে দূরে রাখা যায়নি।
এম এইচ ডি/ আইকেজে