গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শুরু- ছবি: সংগৃহীত
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) শুরু হয়েছে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোটগ্রহণ। আজ বৃহস্পতিবার (২৫ মে) সকাল ৮টায় শুরু হওয়া এ ভোটগ্রহণ বিরতিহীনভাবে চলবে বিকেল ৪টা পর্যন্ত।
এদিকে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে করতে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। আয়তনের দিক দিয়ে দেশের সর্ববৃহৎ গাজীপুর সিটি করপোরেশনে মেয়র, ৫৭টি ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর এবং ১৯টি সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মেয়র পদে ৮ জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২৪৩ জন এবং সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ৭৮ জন, অর্থাৎ মোট ৩২৯ জন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর জন্য ৪৮০টি ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া প্রতিটি কেন্দ্র সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে।
সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণের জন্য ৪৮০ জন প্রিজাইডিং অফিসার, ৩ হাজার ৪০৯ জন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার এবং ৬ হাজার ৯৯৪ জন পোলিং অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচনসহায়ক রয়েছেন ১০ হাজার ৯৭১ জন। প্রায় ৩৩০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ৩০ লক্ষাধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত গাজীপুর সিটি করপোরেশনে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ভোটার ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন, নারী ভোটার ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন এবং হিজড়া ১৮ জন।
নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার মো. ফরিদুল ইসলাম জানান, বুধবার প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ইভিএম মেশিনসহ যাবতীয় সরঞ্জাম এবং ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পাঠানো হয়েছে। আমাদের সম্পূর্ণ প্রস্তুতি রয়েছে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ করার।
মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন যারা
মেয়র পদে এবারের নির্বাচনে আট জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তারা হলেন- আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আজমতউল্লা খান (নৌকা), স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন (টেবিল ঘড়ি), জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন (লাঙ্গল), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মনোনীত প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান (হাতপাখা), জাকের পার্টির মনোনীত প্রার্থী রাজু আহমেদ (গোলাপ ফুল), গণফ্রন্টের আতিকুল ইসলাম (মাছ), স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহনুর ইসলাম রনি (হাতি) ও হারুন অর রশিদ (ঘোড়া)।
এর মধ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমতউল্লা খান দলীয় অবস্থানের কারণে শক্তিশালী প্রার্থী। দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে নির্বাচনে বিএনপির কোনো প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করায় বিজয়ের ব্যাপারে তাকে যেমন নির্ভার মনে হচ্ছে, বাস্তবে তা এখন আর তেমন দেখা যাচ্ছে না। কারণ সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও ঋণখেলাপির দায়ে তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়। জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মেয়র পদে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। একপর্যায়ে জায়েদা খাতুনই আজমতউল্লা খানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। তাই মেয়র পদে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আজমতউল্লা খান ও জায়েদা খাতুনের মধ্যে—এমন অভিমত ভোটার ও নগরবাসীর।
৩৫১টি ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র
নির্বাচনে মোট ৪৮০টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৩৫১টি গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) কেন্দ্র এবং ১২৯টি অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ, অর্থাৎ সাধারণ কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। রিটার্নিং কর্মকর্তা জানান, গুরুত্বপূর্ণ ভোটকেন্দ্রগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ছাড়াও পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে নির্বাচন ও ভোটগ্রহণ নিয়ে জনমনে সংশয় ও শঙ্কা এখনো সেভাবে কাটেনি।
দীর্ঘদিনের নেতা আজমতউল্লা খান
আজমতউল্লা খান ছাত্রজীবন থেকেই ছাত্রলীগ এবং পরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। তার রাজনৈতিক জীবন প্রায় ৫৮ বছরের। তিনি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৯৫ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৮ বছর তিনি সাবেক টঙ্গী পৌরসভার তিনবার চেয়ারম্যান ও মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন। গাজীপুর মহানগর গঠিত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
গৃহিণী থেকে মেয়র পদপ্রার্থী জায়েদা খাতুন
জায়েদা খাতুন তার নির্বাচনি হলফনামায় নিজেকে গৃহিণী ও স্বশিক্ষিত বলে উল্লেখ করেছেন। তার স্বামী মো. মিজানুর রহমান চার-পাঁচ বছর আগে মারা যান। বর্তমানে জাহাঙ্গীর আলমসহ তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছেন বলে জানা গেছে। তিনি যথার্থই গৃহিণী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। কারণ মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করার আগে রাজনীতি বা সামাজিক কোনো ক্ষেত্রে তার নাম শোনা যায়নি। তবে এলাকায় তিনি জনদরদি হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে এবং শিক্ষার্থীসহ গরিব-দুঃখী মানুষকে বরাবরই আর্থিক সহায়তা করেন।
মাঠে থাকবে র্যাব-বিজিবি
রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় সূত্র জানায়, নির্বাচনের দিন গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) কেন্দ্রসমূহে অস্ত্রসহ একজন এসআই অথবা এএসআই ও চার জন কনস্টেবল, অস্ত্রসহ এক জন অঙ্গীভূত আনসার পিসি, একজন অস্ত্রসহ আনসার এপিসি, লাঠিসহ চার জন নারী ও ছয়জন পুরুষ আনসার/ভিডিপি সদস্যসহ মোট ১৭ জন মোতায়েন থাকবে। আর সাধারণ কেন্দ্রসমূহে ১৬ জন মোতায়েন থাকবে।
নির্বাচনি এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে মোবাইল টিম ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য পুলিশ, এপিবিএন, ব্যাটালিয়ন আনসার, বিজিবি ও র্যাব দায়িত্ব পালন করবে। এর মধ্যে প্রতিটি সাধারণ কেন্দ্রে একটি করে মোবাইল ফোর্স, প্রতি তিনটি সাধারণ ওয়ার্ডে একটি করে স্ট্রাইকিং ফোর্স মোতায়েন থাকবে। এছাড়া প্রতিটি থানা এলাকায় একটি করে মোট আটটি রিজার্ভ স্ট্রাইকিং ফোর্স মোতায়েন থাকবে। প্রতি দুটি সাধারণ ওয়ার্ডে একটি করে মোট ৩০টি র্যাবের টিম থাকবে। নগরীর পাঁচটি সাধারণ ওয়ার্ডে এক প্লাটুন করে মোট ১৩ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন থাকবে।
মেট্রোপলিটন পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, প্রার্থী বা প্রভাবশালীদের বাড়ির কাছাকাছি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থাপিত কেন্দ্র, অতীতে যেসব ভোটকেন্দ্রে সহিংসতা হয়েছিল, যেসব ভোটকেন্দ্রে যোগাযোগব্যবস্থা খারাপ এবং এলাকার গোয়েন্দা তথ্যসহ বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও প্রশাসনিক ভাষায় এসব কেন্দ্রকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ উল্লেখ করা হয়েছে।
সাধারণ ছুটি ঘোষণা
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনি এলাকায় আজ বৃহস্পতিবার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। রবিবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি-৪ শাখার উপসচিব সোনিয়া হাসান স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এই আদেশ জারি করা হয়। এই দিন সব ব্যাংকও বন্ধ থাকবে।
নগর জুড়ে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেছেন, নির্বাচন উপলক্ষ্যে পুরো নগরীকে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনে যেসব কেন্দ্র অতি গুরুত্বপূর্ণ, সেসব কেন্দ্রে অধিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া কেন্দ্র থেকে এজেন্ট বের করে দেওয়ার যেসব কথা প্রচলন রয়েছে এমন কোনো ঘটনা ঘটবে না। গতকাল বুধবার সকালে নগরীর রাজবাড়ি মাঠে ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালনকারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ব্রিফিংকালে তিনি এসব কথা বলেন।
আরো পড়ুন: মেট্রোরেলের সুরক্ষায় এমআরটি পুলিশ গঠিত
পুলিশ কমিশনার আরো বলেন, আমরা গাজীপুরবাসীকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করে দেখিয়ে দিতে চাই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো ব্যত্যয় ঘটলে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করলে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
এদিকে রিটার্নিং কর্মকর্তার অফিস সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনে ৫৭টি ওয়ার্ডে ৫৭ জন ম্যাজিস্ট্রেট এবং অতিরিক্ত ১৯ জনসহ সর্বমোট ৭৪ জন ম্যাজিস্ট্রেট এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন।
এম/
খবরটি শেয়ার করুন