ছবি: সংগৃহীত
জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব একেবারে হাস্যকর এবং এই বিধান বদলানোর জন্য ভালো আইনগত যুক্তি আছে-প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেয়ার আগে এরকম বিশ্বাসের কথা বলেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
আমেরিকার ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই সোমবার (২০শে জানুয়ারি) এক নির্বাহী আদেশে পূর্বঘোষণা অনুসারে দেশটির জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের প্রক্রিয়া বাতিলের উদ্যোগ নেন তিনি। তবে সংবিধান বিশেজ্ঞদের মতে তার এই আদেশ আইনগত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। কারণ জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকার যেহেতু দেশের সংবিধানে নিশ্চিত করা আছে, তাই তার এই আদেশ আইনগত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।
জানা গেছে, আদেশে সই করার সময় ট্রাম্প নিজেও স্বীকার করেন যে, এই আদেশ আইনগত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। ডোনাল্ড ট্রাম্প যে এ সিদ্ধান্ত নেবেন, তা আগে থেকেই অনুমেয় ছিল। হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার পর তাই তিনি তার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়নে কোন রকম কালক্ষেপণ করেন নি। হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে এর মধ্যেই বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, এবার থেকে আর আমেরিকায় জন্মগতভাবে নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার থাকবে না। এই আদেশের ফলে, যেসব দম্পতির বৈধ অভিবাসীর মর্যাদা নেই আমেরিকায় জন্ম নেওয়া তাদের শিশুদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না আর।
এর আগে প্রায় ১৫০ বছর ধরে মার্কিন ভূখণ্ডে জন্ম নেওয়া শিশুরা ‘জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব’ পেয়ে আসছেন। তবে সেই অধিকারকে বাতিল করে এবার নির্বাহী আদেশ জারি করলেন ট্রাম্প। এই আদেশ কার্যকর হবে চলতি বছরের ২০শে ফেব্রুয়ারি থেকে। ট্রাম্পের নির্দেশ অনুযায়ী, আমেরিকায় যদি অবৈধ অভিবাসীর সন্তান জন্ম নেয়, তাহলে সেই শিশুরা আর মার্কিন নাগরিক হবেন না। এদিকে জন্ম নেওয়া শিশুর মা-বাবা যদি বৈধ ভাবেই আমেরিকায় গিয়ে থাকেন, কিন্তু তাদের মধ্যে কোনও একজন সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা নন, তাহলেও সেই শিশু মার্কিন নাগরিকত্ব পাবে না। এছাড়া কেউ যদি স্টুডেন্ট ভিসা, ওয়ার্ক ভিসা বা টুরিস্ট ভিসায় আমেরিকায় গিয়ে সন্তানের জন্ম দেয়, তাহলেও সেই শিশু আর মার্কিন নাগরিক হবে না।
নতুন নিয়ম অনুসারে, যদি শিশুর বাবা আমেরিকার নাগরিক বা স্থায়ী বাসিন্দা না হন এবং মা অবৈধভাবে আমেরিকায় অবস্থান করেন বা শিক্ষার্থী, পর্যটক বা কর্মসংস্থান ভিসার মতো অস্থায়ী ভিসায় থাকেন, তাহলে সেই শিশু আর স্বয়ংক্রিয়ভাবে মার্কিন নাগরিকত্ব পাবে না। তবে বাবা-মায়ের কেউ আমেরিকান নাগরিক হলে সন্তান জন্মের পরই মার্কিন নাগরিক বলে স্বীকৃতি পাবে।
অনেকে মনে করেন, ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ আমেরিকায় জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকারের সাংবিধানিক নিশ্চয়তাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। আর এই নির্দেশের ফলে আমেরিকায় বসবাসকারি এই অঞ্চলের বিশেষ করে বাংলাদেশ এবং ভারতের অনেক অভিবাসীকে নিশ্চিত ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। কারণ মার্কিন নাগরিকত্ব-গ্রিনকার্ড অর্জনের একটি সহজ এবং জনপ্রিয় পথ হচ্ছে মার্কিন ভূখণ্ডে সন্তান জন্মদান। আমেরিকার আইন অনুযায়ী, কোনও শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্র তাকে আমেরিকার নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হয় এবং ওই শিশুর বয়স ১৮ পার হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে বড় করা এবং দেখাশোনা করার জন্য তার বাবা-মাকে বৈধভাবে বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়। আর একবার বৈধ বসবাসের অনুমতি পেলে নাগরিকত্ব ও গ্রিনকার্ড প্রাপ্তির পথও অনেক সহজ হয়। আর তাই প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ট্রাম্পের এই আদেশ আমেরিকায় বসবাসকারী বৈধ নথিবিহীন অভিবাসীদের জন্য বড় ধাক্কা।
অবশ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, দায়িত্ব গ্রহণ করে বিভিন্ন ধরনের নির্বাহী আদেশ জারি করা মার্কিন প্রেসিডেন্টদের জন্য সাধারণ একটি বিষয়। এ ধরনের আদেশের আইনি ভার আছে। কিন্তু পরবর্তী প্রেসিডেন্ট বা আদালত এসব আদেশ চাইলে বাতিল করতে পারেন। আমেরিকার দেড়শো বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রতিষ্ঠিত সংবিধানে অনুযায়ী, আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারীরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে একজন আমেরিকান নাগরিক। কিন্তু, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আদেশটি শিশুদের নাগরিকত্বের নথি প্রদান না করার জন্য ফেডারেল সংস্থাগুলিকে নির্দেশ দিয়েছেন। ট্রাম্পের এই আদেশের অর্থ হলো, সেইসব শিশু নাগরিকত্ব লাভ করবে না, যাদের মা এবং শিশুর জন্মের সময় আমেরিকায় থাকার জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। এর ফলে, তারা সামাজিক নিরাপত্তা কার্ড এবং পাসপোর্টের মতো নথিভুক্ত অভিবাসীদের নাগরিকত্ব-নিশ্চিতকরণ নথিগুলি উপলব্দ করবে না। ট্রাম্প প্রশাসন কার্যকরভাবে তাদের সরকারি স্কুল, স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি এবং আবাসন সুবিধার মতো সরকারি পরিষেবাগুলি থেকে বাদ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
তবে এটি করতে যেয়ে ব্যাপক বিতর্ক ও বাধার মুখে পড়বেন ট্রাম্প। কারণ, মার্কিন সংবিধানের যে কোনো পরিবর্তনের জন্য কংগ্রেসে সর্বোচ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের প্রয়োজন তারপর, দেশটির তিন-চতুর্থাংশ রাজ্যের অনুমোদন প্রয়োজন। নিশ্চিতভাবেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেন তিনি। এছাড়া, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এককভাবে সংবিধান সংশোধন করার এখতিয়ার রাখেন না, এবং জন্মগত অধিকার সূত্রে নাগরিকত্ব সীমিত বা বাতিল করার কোনো নির্বাহী আদেশ মার্কিন সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীর লঙ্ঘন। এ ছাড়াও ট্রাম্পের আদেশ আমেরিকার সর্বোচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হলে, তা বাতিল বলে গণ্য হতে পারে।
তবে ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক এবং অভিবাসন ও নাগরিকত্ব আইন বিশেষজ্ঞ ড. আমান্ডা ফ্রস্টের মতে, ‘সুপ্রিম কোর্ট কোনো এক সময়ে জন্মগত নাগরিকত্বের প্ররোচনাকে সীমিত করার যুক্তি খুঁজে পেতে পারে।’
কেসি/কেবি