সোমবার, ২৬শে আগস্ট ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১১ই ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পাকিস্তানের রাজনীতিতে নারীদের অবস্থান

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ০১:২৮ অপরাহ্ন, ৩১শে মে ২০২৩

#

ছবি: সংগৃহীত

মরিয়ম সুলেমান আনিস

আমি যখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি, তখন পাকিস্তানের তৎকালীন ফেডারেল শিক্ষামন্ত্রী, জুবাইদা জালাল এসেছিলেন পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় বন্দর শহর গোয়াদরে আমাদের স্কুলে। এটাই আমার প্রথম কোন রাজনীতিবিদ, বিশেষ করে নারী রাজনীতিবিদের সাথে সাক্ষাৎ। তাকে দেখে, তার মুখে বেলুচের ভাষা শুনে কিংবা তার পরিধানকৃত বেলুচের পোশাক আমায় অনুপ্রাণিত করেছিল। আমি তার মতোই ক্ষমতাবান হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। কিন্তু আমার পরিবারের কোন মহিলাই কোনদিন বাড়ির বাইরে কাজ করেন নি, সে পরিবার থেকে রাজনীতিবিদ হওয়ার স্বপ্নপূরণ যে কতোটা দুঃসাধ্য, তা আমি তখন বুঝিনি।

ধীরে ধীরে আমি যখন বড় হতে থাকি, তখন পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা - বিশেষ করে আমার নিজ প্রদেশ বেলুচিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতায় আমি উপলব্ধি করতে পারি রাজনীতিবিদ হতে পারা ঠিক কতোটা কঠিন এবং তখন আস্তে আস্তে আমার রাজনীতিবিদ হওয়ার স্বপ্ন মুছে যায়। আমি বুঝতে পারি যে আমার পছন্দের ক্ষেত্র হলো সমাজসেবা এবং লেখালেখি। তবে যাইহোক, পাকিস্তানের মতো দেশে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ আমাকে বরাবরের মতোই অনুপ্রাণিত করেছে এবং আমি প্রায়ই মহিলা রাজনীতিবিদদের সাক্ষাৎ নিয়েছি ও তাদের সম্পর্কে লিখেছি।

মহিলা রাজনীতিবিদদের সাথে সাক্ষাৎকারের ক্ষেত্রে আমার প্রথম প্রশ্নই ছিল তাদের জন্য রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আসা কতোটা সহজ কিংবা জটিল ছিল। তাদের প্রত্যেককেই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আসছে নানা প্রতিকূলতার মোকাবেলা করতে হয়েছে। এমনকি যাদের পারিবারিক ইতিহাস রাজনীতির সাথে জড়িত, তাদের জন্যেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রবেশ করা সমান জটিলতায় পরিপূর্ণই ছিল।

যেমন, একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর কন্যা হিসেবে বেনজির ভুট্টোর রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ বেশ জটিলই ছিল। তিনি পাকিস্তানের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র মহিলা প্রধানমন্ত্রী (১৯৮৮ থেকে ১৯৯০ এবং ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত)। কিন্তু ২০০৭ সালে তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচনী প্রচারণার সময় তাকে হত্যা করা হয়।

পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলা এবং রাজনৈতিক সহিংসতার ভয় নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলের মাঝেই বিদ্যমান। তবে নারীদেরকে আরো বেশি প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়, যেমন, লিঙ্গবৈষম্য, দুর্ব্যবহার, সুযোগের অভাব, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাব। এমনকি তাদের নিজেদেরই রাজনৈতিক দলের মধ্যে খারাপ ব্যবহারের শিকার হন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মহিলাদের ক্ষমতাকে সীমিতও করে দেওয়া হয়। মনোনয়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং নেতৃত্বের পদের জন্য লড়াই প্রতিটি ক্ষেত্রে মহিলারা নানা প্রতিকূলতার শিকার হন।

পাকিস্তানে জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক (৪৯শতাংশ) হচ্ছে নারীরা, তবুও সিনিয়র, নির্বাহী, বা আইনসভার ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ খুবই অল্প, মাত্র ৪.৫ শতাংশ, যা সারা বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে সর্বনিম্ন। প্রতি ১০ জন নারীর মধ্যে মাত্র ২ জন নারী শ্রমশক্তিতে অংশ নিচ্ছে। এমনকি নাগরিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও নারীদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা সীমিত। ২০১৮ সালের নির্বাচনে, ভোট দেওয়া জন্য নিবন্ধিত ৪৬০ লাখ নারীদের মধ্যে মাত্র ৪০ শতাংশ ভোট প্রদান করে।

অর্থাৎ পাকিস্তানে নারীরা ভোটার, প্রার্থী কিংবা রাজনৈতিক দলের সদস্য হিসেবে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারে না। এজন্য পাকিস্তানের সংবিধান নারীদের জন্য কোটার ব্যবস্থা করে। জাতীয় পরিষদ ও সিনেট উভয় ক্ষেত্রেই ১৭ শতাংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত করা হয়।

২০০০ সালে, স্বৈরশাসক পারভেজ মোশাররফের বিতর্কিত সামরিক শাসন লিঙ্গ বৈষম্যতা মোকাবেলার জন্য "ক্ষমতা হস্তান্তর পরিকল্পনা" চালু করে।

প্রাক্তন ফেডারেল শিক্ষামন্ত্রী, জুবাইদা জালাল বলেন, সবাই হয়তো একমত না ও হতে পারেন তবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বৈরশাসকই মহিলাদের উৎসাহিত করেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, নতুন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে স্থানীয় আসনের ৩৩ শতাংশ নারীদের জন্য বরাদ্দ করা হয়। 

জালাল মূলত ইরান সীমান্তের কাছে বেলুচিস্তান প্রদেশের একটি ছোট শহর মান্দের বাসিন্দা। এখনও পর্যন্ত, তিনিই একমাত্র মহিলা যিনি মাক্রান বিভাগ থেকে নির্বাচিত হয়েছেন।

তবে স্বৈরশাসকের অধীনে কাজ করার জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন জুবাইদা জালাল। যদিও মোশাররফ সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে অনেক পুরুষেরাও কাজ করেছেন, তবুও সমালোচনার শিকার প্রায়শই নারীদেরই হতে হয়।

পাকিস্তানের সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাচেতনায় পরিপূর্ণ। ফলস্বরূপ, মহিলাদেরকে প্রায়ই কারণে অকারণে সমালোচনার শিকার হতে হয়।

সম্প্রতি পাকিস্তানের আবহাওয়া মন্ত্রী, শেরি রহমান টাইম ম্যাগাজিনের ২০২৩ সালের ১০০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় স্থান দখল করে নেন। গত নভেম্বরে, মিশরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৭ এ তিনি ঝুঁকিপূর্ণ অনুন্নত দেশগুলোর সম্পর্কে কথা বলেন। তার এবং অন্যান্যদের প্রচেষ্টার ফলে অনুন্নত দেশগুলোর জন্য একটি তহবিল প্রতিষ্ঠা করা হয়।

মহিলা রাজনীতিবিদদের এতো অবদান থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের মহিলাদের জন্য রাজনীতিকে পেশা হিসেবে এখনও বিবেচনা করা হয় না। 

ভোটার এবং প্রার্থী হিসেবে নারীদের সংখ্যা বরাবরই কম। নিরাপত্তাহীনতার সাথে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মনোভাবের কারণে মেয়েরা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এখনও স্বাধীনভাবে আসতে পারছে না। তা সত্ত্বেও বিক্ষোভ বা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সময় নারীরা পুলিশ বাহিনির হাত থেকে রেহাই পায় না।

নারীদের সম্মান করা উচিত এখন শুধুমাত্র ঘরবন্দী নারীদের জন্যেই মেনে চলা হচ্ছে, যে নারীরা ঘরে থাকেন এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন না।

৯ মে, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের গ্রেফতারের পর বিক্ষোভের সময় মহিলাদের উপরেও অত্যাচার চালায় পুলিশেরা। তবে ব্যাপক বিরোধিতার ফলে অবিলম্বে ইমরান খানকে জামিনে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। 

ইমরান খানের দলের মহিলা কর্মী ও সমর্থকদের পুলিশ টেনে নিয়ে যায় এবং মানবাধিকার বিষয়ক প্রাক্তন ফেডারেল মন্ত্রী শিরিন মাজারির মতো নারী রাজনীতিবিদদের গ্রেফতার করে।

স্বাধীন গ্রুপ, উইমেন ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট, মহিলা বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশি সহিংসতার নিন্দা জানায়। তবে অনেকেরই মতে, পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ বা পিটিআই দল নিজেই তাদের মহিলা কর্মীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে না।

২০১৮ সালে পিটিআই যখন দলীয় টিকিট প্রদান করে, তখন মহিলা দলের কর্মীরা অসন্তুষ্ট হন এবং দাবি করেন যে যোগ্যতা এবং কাজ বিবেচনা না করেই টিকিট বরাদ্দ করা হয়েছে।

তারা নারী কোটা পূরণ করতেই যেনতেন প্রকারে টিকিট প্রদান করেন এবং সেখানে যোগ্যতা বিবেচনা করা হয় না।

বেলুচিস্তানের ন্যাশনাল পার্টির সদস্য তাহিরা খুরশিদ বলেন "আমাকে আমার দল দুবার বেলুচিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে মহিলাদের সংরক্ষিত আসনের জন্য মনোনীত করেছিল এবং একবার দেশের উচ্চকক্ষ, সিনেটে। দুর্ভাগ্যবশত, তিনবারই আমি ব্যর্থ হই। তবে আমি কখনো হার মানি নি।"

কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, পাকিস্তানে রাজনৈতিক ক্ষমতা নিঃসন্দেহে পুরুষতান্ত্রিক। মহিলাদের তাদের স্থান শক্ত করতে হলে আরো লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। 

দ্য ডিপ্লোমেট. কম হতে অনুবাদ করা

Important Urgent

খবরটি শেয়ার করুন