ছবি: সংগৃহীত
মসজিদ আল্লাহর ঘর। পৃথিবীর সর্বোত্তম স্থান। এখানে দৈনিক পাঁচবার সালাত আদায়ের জন্য মুসলমানগণ মিলিত হন। মসজিদ কেবল ইবাদতের স্থান নয়; বরং তা সামাজিক সম্প্রীতি ও শৃঙ্খলা স্থাপনে অসামান্য অবদান রাখে। এখানে কয়েকটি দিক তুলে ধরা হলো:
# পবিত্রতম স্থান:
পৃথিবীর পবিত্রতম স্থান মসজিদ। কারণ এখানে কেবল মহান স্রষ্টা ও রিজিকদাতাকে স্মরণ করা হয়। মহানবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় স্থান মসজিদ এবং সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্থান বাজার।’ (মুসলিম)
দুনিয়ার সব কার্যক্রম থেকে মুক্ত হয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে হয় এবং সেখানে দুনিয়াবি অথবা অশ্লীল কোনো আলোচনা হয় না, তাই মসজিদ শ্রেষ্ঠ। অপরদিকে বাজারে প্রতারণা, মিথ্যা, ভেজাল, মারামারিসহ নিষিদ্ধ কার্যাবলি সংঘটিত হয়ে থাকে, তাই বাজারকে নিকৃষ্ট স্থান বলা হয়েছে।
# সাম্য ও সম্প্রীতি:
সমাজের ছোট-বড়, ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু-সবাই দৈনিক পাঁচবার মসজিদে মিলিত হয়ে একই ইমামের পেছনে সব ধরনের ভেদাভেদ ভুলে অপূর্ব সাম্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এ ছাড়া দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত একত্রে পড়ার কারণে তাঁরা পরস্পর সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হন। কারণ প্রত্যেক মুসল্লি তাঁদের মাঝে সালাম বিনিময় করেন। আর সালাম সম্প্রীতি স্থাপনের প্রধান হাতিয়ার।
মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা ইমানদার না হওয়া পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর যতক্ষণ না তোমাদের মাঝে পারস্পরিক ভালোবাসা সৃষ্টি হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত ইমানদার হতে পারবে না। আমি কি তোমাদের এমন একটি কাজ বলে দেব, যা করলে তোমরা পরস্পর ভালোবাসতে থাকবে? আর তা হচ্ছে, তোমরা পরস্পরের মধ্যে সালাম বিনিময় করো।’ (মুসলিম)
# ভ্রাতৃত্ববোধ:
মসজিদে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশনা দিয়ে আল্লাহ তা'আলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, যখন জুমার দিনে সালাতের জন্য আহ্বান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে ধাবিত হও এবং বেচাকেনা বর্জন করো। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জানতে।’ (সুরা জুমুআহ: ৯)
যখন মুসল্লিরা দুনিয়াবি কার্যক্রম ছেড়ে মসজিদে মিলিত হন, তখন তাঁদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি হয়। কারণ সবারই উদ্দেশ্য মহান প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জন করা। ফলে তাঁরা পারস্পরিক ভালো-মন্দ খোঁজখবর রাখেন ও মতবিনিময় করেন, যা তাঁদের মধ্যে আন্তরিকতা বাড়ায়। এ জন্যই আয়াতে এটিকে কল্যাণকর বলা হয়েছে।
# শৃঙ্খলাবোধ:
মসজিদে অত্যন্ত নীরব হয়ে ইমামের পেছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে শৃঙ্খলার সঙ্গে সালাত আদায় করতে হয়, যা মুসল্লিদের শৃঙ্খলাবোধ শেখায়। এভাবেই মহানবী (সা.) সাহাবিদের শান্তি-শৃঙ্খলার প্রশিক্ষণ দিয়ে সালাতের শুরুতে বলতেন, ‘তোমরা কাতার সোজা করো। কেননা, কাতার সোজা করা সালাতের পরিপূর্ণতার অংশবিশেষ।’ এমনকি মহানবী (সা.) নিজেই এসে কাতার সোজা করে দিতেন।’ (বুখারি)
# নেতৃত্ব ও আনুগত্য:
সব মুসল্লির একজন নেতা থাকেন, যিনি ইমাম নামে পরিচিত। তাঁর নেতৃত্বেই সালাত আদায় করতে হয়। কোনো মুসল্লি যদি তাঁর সঠিক আনুগত্য না করেন, তবে তাঁর সালাত নষ্ট হয়। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যখন তিনজন একত্র হবেন, তখন তাঁদের মধ্যে যিনি অধিকতর বিশুদ্ধ কোরআন জানেন, তিনিই ইমাম হবেন।’ (বুখারি)
তিনি আরও বলেন, ‘যখন তোমাদের কেউ সালাতে আসবে, এমতাবস্থায় ইমামকে যে অবস্থায় পাবে, সেই অবস্থার অনুসরণ করবে।’ (তিরমিজি)
মানুষ নেতৃত্ব ও আনুগত্যের এ শিক্ষাকে দুনিয়ার কাজেও প্রয়োগ করতে পারে।
# নিয়মানুবর্তিতা:
মসজিদে পাঁচবার সালাত আদায়, আজান, ইকামত, ইমামের পেছনে ইকতেদাসহ সালাতের মধ্যকার সব কাজ ব্যক্তিকে নিয়মানুবর্তী করে তোলে। তাকবিরের মাধ্যমে সালাত শুরু হয় এবং সালামের মাধ্যমে তা শেষ হয়। এসব ধারাবাহিকতা নষ্ট হলে সালাত শুদ্ধ হবে না। অনুরূপভাবে অজুর মধ্যেও ধারাবাহিকতা রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, যখন তোমরা সালাতে দাঁড়াতে চাও, তখন তোমাদের মুখ ও কনুই পর্যন্ত হাত ধুয়ে নাও, মাথা মাসেহ করো এবং টাখনু পর্যন্ত পা ধৌত করো।’ (সুরা মায়িদা: ৬)। এসব নিয়মানুবর্তিতা ব্যক্তিকে জীবনের সব ক্ষেত্রে নিয়মানুবর্তী করে তোলে।
# সময়-চেতনা:
মসজিদ মানুষকে সময়ানুবর্তিতাও শেখায়। নির্দিষ্ট সময়ে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের মধ্য দিয়ে মসজিদ মানুষকে সময়ানুবর্তী, দায়িত্বজ্ঞান ও কর্তব্যপরায়ণ করে তোলে। সালাত নির্দিষ্ট সময়ে আদায় করা ফরজ। আল্লাহ বলেন, ‘নির্দিষ্ট সময়ে সালাত কায়েম করা মুমিনদের জন্য অবশ্যকর্তব্য।’ (সুরা নিসা: ১০৩)। অনুরূপভাবে সালাতের পর অলসভাবে বসে না থেকে জীবিকা উপার্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘এরপর যখন সালাত সমাপ্ত হয়, তখন পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) অন্বেষণ করো।’ (সুরা জুমুআহ: ১০)।
# শিক্ষা-সংস্কৃতি:
পাঠাগার স্থাপন, শিশু-বয়স্ক শিক্ষার ব্যবস্থা, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সামাজিক সংস্কার ও ইসলামি শিক্ষা বিস্তারে মসজিদের অবদান অপরিসীম। মহানবী (সা.) প্রতিষ্ঠিত প্রথম মসজিদই ছিল প্রথম উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। মসজিদে জ্ঞানচর্চার ফজিলত সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর ঘরসমূহের মধ্যে কোনো ঘরে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করলে এবং পারস্পরিক পর্যালোচনার জন্য কোনো দল একত্র হলে তাদের ওপর প্রশান্তি নাজিল হয়, রহমত তাদের আচ্ছাদিত করে, ফেরেশতাগণ তাদের বেষ্টন করে এবং আল্লাহ তাদের সম্পর্কে ফেরেশতাদের সামনে আলোচনা করতে থাকেন।’ (মুসলিম)।
আরো পড়ুন: হিজরি নববর্ষে মসজিদুল হারামে নতুন মিম্বার
সুতরাং পাঁচ ওয়াক্ত সালাত মসজিদে আদায় করে সামাজিক সম্প্রীতি স্থাপন করা, শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপন করা এবং মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভে সচেষ্ট হওয়া আমাদের একান্ত কর্তব্য।
ড. এ এন এম মাসউদুর রহমান
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
এম এইচ ডি/ আই. কে. জে/