ছবি: সংগৃহীত
যৌনশক্তি বাড়াতে পাকিস্তানের বিরল পাখি শিকার আরব শেখদের অন্যতম শখের বিষয়। প্রতিবছর আরব দেশগুলো থেকে বহু মানুষ শুধুমাত্র এই কারণেই পাকিস্তানে ভিড় করেন। নির্দিষ্ট গাড়ি ভাড়া, তাবুতে রাত কাটানোসহ এই কাজের জন্য হাজার হাজার ডলার খরচ করেন তারা। তাদের এই বিলাসিতাপূর্ণ শিকারের বিস্তারিত জানিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি।
১৯৩০ সালের কথা। দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানের একটি ছোট্ট উপকূলীয় শহর পাসনিতে হাজির হলেন দু’জন সেনা অফিসার। তারা একটি কার রেন্টাল সার্ভিসের দোকানে গাড়ি দাঁড় করালেন। একজন দোকানের মালিককে প্রশ্ন করলেন ‘আপনাদের কাছে ভালো গাড়ি আছে? একজন আরব শেখকে পাঞ্চগুর নিয়ে যেতে হবে।
মালিক বললো, হ্যাঁ আছে। এরপর তিনি তার ছেলে হানিফকে পাঠালেন গাড়ি দেখানোর জন্য। ওই গাড়িটি ভাড়া করা হয়েছিল প্রিন্স সুরুর বিন মোহাম্মদ আল-নাহিয়ানের জন্য। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ছয় রাজ পরিবারের একটির সদস্য প্রিন্স সুরুর।
তিনি ৬৫ কিলোমিটার দূরে পাঞ্চগুরে যেতে চেয়েছিলেন হুবারা বাস্টার্ড পাখি শিকারের জন্য। এটি একটি বিরল পাখি। প্রচলিত আছে যে এর মাংস যৌনশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। গাড়িটা শেখ-এর পছন্দ হলো এবং তিনি ৩১-বছর বয়সী হানিফকে সাথে নিয়ে রওনা হলেন। সেটা ছিল দু’জনের মধ্যে দীর্ঘদিনের এক বন্ধুত্বের সূচনা। হাজি হানিফ গত ৩৭ বছর ধরে হুবারা শিকার করতে আসা আরব রাজপরিবারের সদস্যদের কেয়ারটেকার হিসেবে কাজ করছেন।
হুবারা পাখির আকার অনেকটা টার্কির মতোই বড়। এই পাখি মানুষের চোখের আড়ালে থাকতে পছন্দ করে। অবিরাম শিকারের ফলে এদের সংখ্যা কমে আসছে। হুবারা শিকার নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তারপরও এই শিকার চলছে।
পাকিস্তানের ক্ষমতাধর গোষ্ঠী গত কয়েক দশক ধরে এই গোপন শিকারে সাহায্য করে আসছে। এর মধ্য দিয়ে উপসাগরীয় দেশগুলোর ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের সাথে তাদের সখ্যতা গড়ে ওঠে। যারা এই শিকারকে সমর্থন করেন, তাদের যুক্তি এর মধ্য দিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এবং বিনিয়োগ আকর্ষণ করা সম্ভব হয়েছে।
তবে এই শিকারের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের প্রকৃত অর্থে কী লাভ হয় তা ঠিক পরিষ্কার না। এসব শিকার পার্টির সাথে জড়িতরা বলেন, আরব প্রিন্সরা একে একেবারেই ব্যক্তিগত বিনোদন বলে বিবেচনা করেন।
প্রতি বছর নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সময়টাতে হাজি হানিফ বালোচিস্তান প্রদেশের শিকারের জায়গাতে আরব রাজ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যান। এটি কৌশলগত-ভাবে গুরুত্বপূর্ণ গোয়াদর বন্দর থেকে গাড়িতে ঘন্টাখানেকে পথ। চলতি বছর শীত মৌসুম শেষ হওয়ার আগে শিকারের বন্দোবস্ত দেখানোর জন্য হাজি হানিফ বিবিসিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
পাসনির মতো জায়গায় শিকারের বিলাসবহুল আয়োজন চোখে পড়ার মতো। এখানে ব্যবহারের জন্য যেসব জিনিস আনা হয়েছে তার কথা এখানকার স্থানীয় লোকজন চিন্তাই করতে পারবেন না। গোয়াদর এয়ারপোর্ট রোডের ওপর আবাসিক এলাকা ছাড়িয়ে কয়েক কিলোমিটার এগিয়ে আমাদের গন্তব্য। সেখানে পৌঁছানোর পর দু’জন গাইড আমাদের নিয়ে গেলেন হাজি হানিফের প্রাসাদোপম বাড়িতে। যে জিপটি আমাদের বহন করছিল লক্ষ্য করলাম তার নাম্বার প্লেটটি ইউএইই’র। যেন আমরা আবুধাবির কোন একটা ছোট্ট জায়গায় গিয়ে হাজির হয়েছি।
এই ধারণাটা আরও জোরালো হলো যখন দেখলাম বাড়ির সামনে সাইনবোর্ডে আবুধাবির রাজপরিবারের সরকারি মনোগ্রাম। ওই এলাকার মরুময় গরিব এলাকার মাঝখানে বাড়িটি যেন একটা মরূদ্যান।
এই এলাকার কয়েক ডজন লোকের চাকরি হয়েছে এখানে। পৌঁছানোর পর দেখলাম এসব কর্মী ব্যস্ত রয়েছে শেখ-এর বাজপাখি রক্ষণাবেক্ষণে, রান্নাঘর পরিষ্কারের কাজে কিংবা বিশাল এক গ্যারেজে বিলাসবহুল এসইউভি মেরামতের কাজে। খাকি পোশাক পরা একজন আমাদের নিয়ে গেল অতিথিদের কামরায়। আতরের গন্ধে ঘরটি ম-ম করছিল।
“কেমন লাগছে জায়গাটি?” সোফায় বসা হাজি হানিফ জিজ্ঞেস করলেন আমাকে। ৬০-বছর বয়সী হাজি সাহেব গল্প করেন সহজভাবে। তিনি আমদের ঘুরে দেখালেন। বছরের পর বছর শেখ-এর শিকার পার্টি সম্পর্কে অনেক গল্প বললেন।
“প্রথমবার তাকে গাড়ি দিয়ে সাহায্য করার পরের বছর তিনি আবার ফিরে আসেন। ১৯৮৮ সালের আমি আর আমার বাবা শেখ সুরুরের ২০টি গাড়ি দেখাশোনা করতাম। এতটাই ভরসা করতেন তিনি আমাদের ওপর।”
পাসনির স্থানীয় প্রায় ৩৫ জন শিকার মৌসুমের তিন মাস এখানে কাজ করেন। বাজপাখি দেখাশোনা করা ছাড়াও এখানে কবুতর প্রশিক্ষণ দেয়ার লোক রয়েছে। তিন জন কাজ করেন শেখ-এর লেবু বাগানে। আরেকজন পোশাক লন্ড্রি করেন। অন্যান্যরা ঘরদোর পরিষ্কার করেন, রান্নাবান্না করেন। একজনকে একটা মোটরসাইকেল দেয়া হয়েছে, যাতে তিনি ঘুরে ঘুরে কোথায় বেশি পাখি পড়েছে সেই জায়গাগুলো খুঁজে বের করতে পারেন।
হাজি হানিফের তিন ছেলেরও চাকরি হয়েছে। বড় ছেলে গ্যারেজ এবং শেখ-এর ২০টি এসইউভি দেখাশোনা করেন। মেজো ছেলেটি কাজ করেন বডি-গার্ড হিসেবে। শেখ-এর নিরাপত্তার দায়দায়িত্ব তার। আর ছোট জনের কাজ হলো স্থানীয় লোকজন যেন অবৈধভাবে হুবারা শিকার বা এই পাখি কালোবাজারে বিক্রি করতে না পারে তা নিশ্চিত করা।
পাকিস্তান আরব শেখদের হুবারা শিকারে আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করে ১৯৭৩ সাল থেকে। দক্ষিণ-পশ্চিম বালোচিস্তানের যেসব জায়গায় শীতকালে এই পরিযাই পাখি আসে সেখানে উপসাগরীয় শেখরা শিকার পার্টি আনতে শুরু করেন। এরপর ১৯৮৯ সালে কেন্দ্র সরকারের সম্মতি নিয়ে বালোচিস্তানের প্রাদেশিক সরকার বিভিন্ন রাজপরিবারের জন্য শিকারের এলাকা বিলি-বণ্টন করে দেয়।
এই ব্যবস্থা অনুযায়ী পাসনি, পাঞ্চগুর এবং গোয়াদর এলাকা দেয়া হয় সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজ পরিবারকে, পূব দিকে উপকূল বরাবর আওয়ারান জেলার ঝাল ঝাও এলাকা দেয়া হয় কাতারের রাজপরিবারকে আর তার থেকে উত্তরে চাগি নামের এলাকাটিকে সৌদির রাজ পরিবারের শিকারের জন্য বরাদ্দ করা হয়। এসময়টাতেই হাজি হানিফ এবং অন্যান্য পরিবারকে কেয়ারটেকার হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়।
উনিশশো সত্তরের দশকে শিকারি দলগুলো হুবারা পাখি যেখানে পড়তো সেখানেই ক্যাম্প বসাতো। এসব শিকার অভিযান চলতো এক সপ্তাহ ধরে। শিকারিরা ক্যাম্পেই সেই পাখির মাংস দিয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে শিকার শেষে শহরে ফিরে আসতো।
কিন্তু বালোচিস্তানে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বছরের পর বছর ধরে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছিল। তখন নিরাপত্তার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ায় আরব শেখরা আর খোলা মরু প্রান্তরে রাত কাটাতেন না। এখন তারা হোটেলে বা হাজি হানিফের মত কেয়ারটেকারদের বাড়িতে থাকেন, এবং কাছাকাছি জায়গায় গিয়ে শিকার করেন।
ঐতিহ্যগতভাবে হুবারা পাখি শিকার করতে বাজপাখি ব্যবহার করা হয়। বাজপাখি হুবারা ধরে আনার পর সেগুলো জবাই করা হয়। শিকারিরা বন্দুকও ব্যবহার করতেন। তবে ইদানীং বৈধ শিকার বেড়ে যাওয়ায় কেয়ারটেকাররা জাল দিয়ে হুবারা ধরে এবং শিকারি দল এসে পৌঁছানোর পর সেগুলো আকাশে ছেড়ে দেয়া হয় বাজপাখির জন্য।
আরো পড়ুন: ব্রিটিশ রাজমুকুটে ৪৪৪ রত্নসহ আর যা যা আছে
হুবারা বাস্টার্ড, যার অন্য নাম এশিয়ান হুবারা, শিকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলছে। এক সময় আরব উপদ্বীপে এই পাখি প্রচুর ছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংস্থা আইইউসিএন-এর হিসেব অনুযায়ী সারা বিশ্বের এখন মাত্র ৫০ হাজার থেকে এক লক্ষ হুবারা পাখি বেঁচে আছে। সেকারণেই সংস্থাটি হুবারাকে হুমকির মুখে থাকা পাখির লাল তালিকার অন্তর্ভুক্ত করেছে।
পাকিস্তানে অনেকেই হুবারা শিকারকে সমর্থন করেন না। তারা বলেন, আরব “প্রভুদের খুশি করার” জন্য এসব করা হয়। অন্যরা অবশ্য বলেন, এই শিকারের মধ্য দিয়ে দুটি ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের মধ্যে সম্পর্ক উষ্ণ হয়। গত কয়েক বছর ধরে উপসাগরীয় থেকে ঋণ এবং বিনিয়োগের অর্থের ওপর পাকিস্তান নির্ভর করে আছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের একজন সাবেক মুখপাত্র জানান, তারা এসব ‘বিব্রতকর ঘটনা’ ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কোন ফল হয়নি। কূটনীতির দিক থেকে এসব যে নিষ্ফল এটা সরকারের মধ্যে অনেকেই বোঝে। কিন্তু তারপরও ক্ষমতাধররা এটা বজায় রাখার পক্ষেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। হুবারা শিকার থেকে গত ২৫ বছরে পাকিস্তান ‘কিছুই পায়নি’ বলে তিনি জানান।
এম এইচ ডি/ আইকেজে
যৌনশক্তি পাকিস্তান আরব শেখ বিলাসিতা হুবারা বাস্টার্ড পাখি প্রিন্স রাজপরিবার
খবরটি শেয়ার করুন