শুক্রবার, ৫ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২১শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাঈদীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশকারী ছাত্রলীগ নেতাদের নিয়ে বিব্রত আ.লীগ

নিউজ ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ০৮:১০ পূর্বাহ্ন, ২০শে আগস্ট ২০২৩

#

প্রতীকী ছবি

দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুতে ছাত্রলীগের কিছু সংখ্যক নেতা-কর্মীর সহানুভূতি দেখিয়ে শোক প্রকাশের ঘটনা সংগঠনটিকে এবং এমনকি খোদ আওয়ামী লীগকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। কেননা সাঈদী মানবতাবিরোধী অপরাধীর দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত  আসামী। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মনে করছে, তাঁদের দলের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোতে ‘সুযোগসন্ধানী’ প্রবেশ করেছে। এসকল সুযোগসন্ধানীদের ‘হাইব্রিড’ হিসেবেও বর্ণনা করছেন তাঁরা।

আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বিভিন্ন সময় তাদের বক্তব্যে এই সুযোগসন্ধানীদের জামায়াত–শিবির হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এখন জামায়াত নেতা সাঈদীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশের ঘটনায় এই সুযোগসন্ধানীদের ওপর দায় চাপাচ্ছেন ক্ষমতাসীনেরা। তবে সুযোগসন্ধানীদের আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোতে প্রবেশের সুযোগ দেওয়ার দায় ক্ষমতাসীনেরা এড়াতে পারেন কি না, এই প্রশ্নে চলছে নানা আলোচনা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সখ্য ও কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতিসহ ইসলামপন্থীদের সমর্থনে অনেক দিন ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ধর্মঘেঁষা একটা নীতি দৃশ্যমান হয়েছে। এর প্রভাব আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোতেও পড়েছে। ফলে এখন ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত সাঈদীর মৃত্যুতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রলীগের অনেক নেতা–কর্মীর শোক প্রকাশের ঘটনায় আওয়ামী লীগের সেই ধর্মঘেঁষা নীতির প্রভাব থাকতে পারে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক হারুন-অর-রশীদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। এ সময় বিভিন্ন অনুপ্রবেশকারী এসেছে। এর চাক্ষুষ প্রমাণ যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর মৃত্যুতে কারও কারও শোক প্রকাশের এই ঘটনা। এটি আওয়ামী লীগের জন্য সতর্কবার্তাও। আরও অনুপ্রবেশকারী থাকতে পারে। এরা দলের আদর্শ ও রাজনীতি ধারণ করে না।’

যদিও ছাত্রলীগের যে নেতা-কর্মীরা সাঈদীর মৃত্যুতে সহানুভূতি দেখিয়ে শোক প্রকাশ করেছেন, তাঁদের তাৎক্ষণিকভাবেই বহিষ্কার করেছে সংগঠনটি। কিন্তু আদর্শিক অবস্থান থেকে নেতা-কর্মীদের প্রস্তুত না করে এ ধরনের সাময়িক ব্যবস্থা কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখবে, এই প্রশ্নও রয়েছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের।

১৪ আগস্ট রাতে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মারা যায়। সেসময় তাঁর মৃত্যুতে ফেসবুকে শোক প্রকাশ করে পোস্ট দেওয়ার কারণে এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জায়গার ছাত্রলীগের ৬৫ নেতা-কর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার ও অব্যাহতি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে ছাত্রলীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, ফেসবুকে শোক প্রকাশ করা নেতার সংখ্যাটা আরও বেশি। ফলে সামনে আরও বহিষ্কারের ঘটনা আসবে।

শুক্রবার (১৮ আগস্ট) পর্যন্ত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে জামালপুরে ১৮, চট্টগ্রামে ১৬, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৯, পাবনায় ৭, নরসিংদীতে ৬, সাতক্ষীরায় ৩ ও গোপালগঞ্জে ৬ জন বহিষ্কৃত হয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে সংগঠনের নীতি ও আদর্শবিরোধী কাজ করার অভিযোগ এনে নিজ নিজ জেলা ছাত্রলীগ সাময়িক বহিষ্কার করেছে। একই সঙ্গে স্থায়ী বহিষ্কারের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে।

ছাত্রলীগের যেসব নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে, তাঁদের অনেকের ফেসবুকের পোস্ট এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরছে। এসব পোস্ট থেকে দেখা যায়, অধিকাংশই মৃত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর জন্য জান্নাত কামনা করেছেন। কেউ কেউ তাঁকে কোরআনের পাখি বলেও উল্লেখ করেন।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সহানুভূতিশীল কেউ ছাত্রলীগ করতে পারবে না, এটা পরিষ্কার। সারা দেশে সাংগঠনিক ইউনিটগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে এ ধরনের কাউকে পেলে ত্বরিত বহিষ্কার করতে হবে।

ছাত্রলীগের নেতারা কেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছেন বলে মনে করেন, এমন প্রশ্ন করা হলে সাদ্দাম হোসেন বলেন, ছাত্রলীগে কিছু সুবিধাবাদী প্রবেশ করেছে। এই সুবিধাবাদীরাই নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়ে সংগঠনের বদনাম করছে।

 ছাত্রলীগের নেতাদের কেউ কেউ আবার মনে করছেন, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ কিংবা অন্যান্য সহযোগী সংগঠনে অতীতে প্রগতিশীল চিন্তা ও চর্চা যতটা কঠোরভাবে মানা হতো, এখন তা কিছুটা আলগা হয়ে গেছে। এ জন্যই ইসলামপন্থীরা সহজে দলের বিভিন্ন স্তরে জায়গা করে নিতে পারছে। 

অবশ্য আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, তাৎক্ষণিক বহিষ্কার করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেলেও এটাকে সংগঠনের একটি দুর্বলতা হিসেবেই দেখা হচ্ছে। এই ঘটনা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। কারণ, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ বরাবরই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শিক রাজনীতির কথা বলে আসছে। সাঈদীর প্রতি সহানুভূতিশীল কেউ ছাত্রলীগে আছে—এই ঘটনা চেতনা ও আদর্শের রাজনীতির ওপর কিছুটা হলেও কালি ফেলেছে।

ছাত্রলীগের একটি সূত্র জানায়, ৩১ আগস্ট সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। ওই দিন সারা দেশ থেকে বিপুল সংখ্যায় নেতা-কর্মীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা হবে। এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত সাঈদীর প্রতি সংগঠনের বিভিন্ন ইউনিটের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সহানুভূতি প্রকাশ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। ওই দিন প্রধানমন্ত্রী হয়তো ছাত্রলীগে ‘অনুপ্রবেশ’ নিয়ে দিকনির্দেশনা দিতে পারেন।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন এবং এস এম কামাল হোসেন দুজনই গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেন, ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ে সুবিধাবাদীর অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এখন সব স্তরে নেতা নির্বাচনের সময় বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে থাকা অনেকে পরবর্তী সময়ে বিএনপিতে যোগ দিয়ে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যও হয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দলবদল নতুন কিছু নয়। তবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত একজনের মৃত্যুতে আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের পদধারী নেতাদের শোক প্রকাশ করাকে অন্যায় হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ জন্যই ত্বরিত বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে টাকাপয়সা নেওয়ার অভিযোগও বিভিন্ন সময় উঠেছে। কমিটিতে স্বজনপ্রীতির অভিযোগও ব্যাপক। নানা উপদলীয় কোন্দলের কারণে দল ভারী করতে বাছবিচার না করেই পদপদবি দেওয়া হচ্ছে। এখন শুধু ছাত্রলীগ নয়, আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য সহযোগী সংগঠনেও শুদ্ধি অভিযান চালানোর কথাও এর আগে অনেকবার বলা হয়েছে; কিন্তু তা কর্যকর হয়নি।

কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের হয়ে চারজন নেতা ছাত্রলীগের দেখভালের দায়িত্বে আছেন। এর অন্যতম আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। এই বিষয়ে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, যুদ্ধাপরাধী-রাজাকার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর প্রতি সহানুভূতিশীল এমন কেউ ছাত্রলীগের নেতা দূরে থাক, সাধারণ সদস্য হওয়ারও যোগ্যতা রাখে না। এমন মনোভাবাপন্ন আরও যদি কেউ ঘাপটি মেরে থাকে, তাদেরও খুঁজে সংগঠন থেকে বের করে দিতে হবে। তিনি দাবি করেন, জামায়াত ও সাম্প্রদায়িক শক্তির অব্যাহত অপপ্রচার দ্বারা কেউ কেউ প্রভাবিত হতে পারে। তবে তারা সবাই সুযোগসন্ধানী, হাইব্রিড। ছাত্রলীগে তাদের জায়গা নেই।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ ইসলামবিরোধী শক্তি-এমন একটা অপবাদ দীর্ঘদিন ধরেই চলছিল। ফলে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার সময় ধর্মীয় নানা বিষয়ে কিছুটা ছাড় দিয়ে চলতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। বিশেষ করে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সখ্য এর অন্যতম উদাহরণ।

এ ছাড়া সারা দেশে মডেল মসজিদ স্থাপন, কওমি শিক্ষাকে স্বীকৃতিদানও রয়েছে। ফলে দলের ভেতর ধর্মভিত্তিক একটা প্রভাব বেড়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের অন্য শরিকেরা বারবারই এই বিষয় তোলার চেষ্টা করেছে।

আওয়ামী লীগের নেতাদের কেউ কেউ মনে করেন, অনুপ্রবেশকারীর পাশাপাশি দলের ভেতরে ইসলামি বা ধর্মভিত্তিক নীতির প্রভাব বৃদ্ধির কারণেও যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পরও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ছাত্রলীগের কেউ কেউ ‘কোরআনের পাখি’ পরিচয় দেওয়ারও চেষ্টা করেছেন।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা তথা সব ধর্মের সম-অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং সমাজতন্ত্র তথা শোষণমুক্ত সমাজ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মূলনীতি।’ আর গঠনতন্ত্রে দলটির অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়িয়া তোলা।’ 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, আদর্শিক অবস্থান থেকে অনেকটা সরে যাওয়ার যে অভিযোগ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে উঠছে, দলটির উচিত সেই অভিযোগকে এখনই গুরুত্ব দিয়ে পর্যালোচনা করা।

দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুতে ছাত্রলীগের কিছু সংখ্যক নেতা-কর্মীর সহানুভূতি দেখিয়ে শোক প্রকাশের ঘটনা সংগঠনটিকে এবং এমনকি খোদ আওয়ামী লীগকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। কেননা সাঈদী মানবতাবিরোধী অপরাধীর দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত  আসামী। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মনে করছে, তাঁদের দলের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোতে ‘সুযোগসন্ধানী’ প্রবেশ করেছে। এসকল সুযোগসন্ধানীদের ‘হাইব্রিড’ হিসেবেও বর্ণনা করছেন তাঁরা।

আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বিভিন্ন সময় তাদের বক্তব্যে এই সুযোগসন্ধানীদের জামায়াত–শিবির হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এখন জামায়াত নেতা সাঈদীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশের ঘটনায় এই সুযোগসন্ধানীদের ওপর দায় চাপাচ্ছেন ক্ষমতাসীনেরা। তবে সুযোগসন্ধানীদের আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোতে প্রবেশের সুযোগ দেওয়ার দায় ক্ষমতাসীনেরা এড়াতে পারেন কি না, এই প্রশ্নে চলছে নানা আলোচনা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সখ্য ও কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতিসহ ইসলামপন্থীদের সমর্থনে অনেক দিন ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ধর্মঘেঁষা একটা নীতি দৃশ্যমান হয়েছে। এর প্রভাব আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোতেও পড়েছে। ফলে এখন ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত সাঈদীর মৃত্যুতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রলীগের অনেক নেতা–কর্মীর শোক প্রকাশের ঘটনায় আওয়ামী লীগের সেই ধর্মঘেঁষা নীতির প্রভাব থাকতে পারে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক হারুন-অর-রশীদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। এ সময় বিভিন্ন অনুপ্রবেশকারী এসেছে। এর চাক্ষুষ প্রমাণ যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর মৃত্যুতে কারও কারও শোক প্রকাশের এই ঘটনা। এটি আওয়ামী লীগের জন্য সতর্কবার্তাও। আরও অনুপ্রবেশকারী থাকতে পারে। এরা দলের আদর্শ ও রাজনীতি ধারণ করে না।’

যদিও ছাত্রলীগের যে নেতা-কর্মীরা সাঈদীর মৃত্যুতে সহানুভূতি দেখিয়ে শোক প্রকাশ করেছেন, তাঁদের তাৎক্ষণিকভাবেই বহিষ্কার করেছে সংগঠনটি। কিন্তু আদর্শিক অবস্থান থেকে নেতা-কর্মীদের প্রস্তুত না করে এ ধরনের সাময়িক ব্যবস্থা কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখবে, এই প্রশ্নও রয়েছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের।

১৪ আগস্ট রাতে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মারা যায়। সেসময় তাঁর মৃত্যুতে ফেসবুকে শোক প্রকাশ করে পোস্ট দেওয়ার কারণে এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জায়গার ছাত্রলীগের ৬৫ নেতা-কর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার ও অব্যাহতি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে ছাত্রলীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, ফেসবুকে শোক প্রকাশ করা নেতার সংখ্যাটা আরও বেশি। ফলে সামনে আরও বহিষ্কারের ঘটনা আসবে।

শুক্রবার (১৮ আগস্ট) পর্যন্ত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে জামালপুরে ১৮, চট্টগ্রামে ১৬, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৯, পাবনায় ৭, নরসিংদীতে ৬, সাতক্ষীরায় ৩ ও গোপালগঞ্জে ৬ জন বহিষ্কৃত হয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে সংগঠনের নীতি ও আদর্শবিরোধী কাজ করার অভিযোগ এনে নিজ নিজ জেলা ছাত্রলীগ সাময়িক বহিষ্কার করেছে। একই সঙ্গে স্থায়ী বহিষ্কারের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে।

ছাত্রলীগের যেসব নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে, তাঁদের অনেকের ফেসবুকের পোস্ট এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরছে। এসব পোস্ট থেকে দেখা যায়, অধিকাংশই মৃত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর জন্য জান্নাত কামনা করেছেন। কেউ কেউ তাঁকে কোরআনের পাখি বলেও উল্লেখ করেন।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সহানুভূতিশীল কেউ ছাত্রলীগ করতে পারবে না, এটা পরিষ্কার। সারা দেশে সাংগঠনিক ইউনিটগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে এ ধরনের কাউকে পেলে ত্বরিত বহিষ্কার করতে হবে।

ছাত্রলীগের নেতারা কেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছেন বলে মনে করেন, এমন প্রশ্ন করা হলে সাদ্দাম হোসেন বলেন, ছাত্রলীগে কিছু সুবিধাবাদী প্রবেশ করেছে। এই সুবিধাবাদীরাই নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়ে সংগঠনের বদনাম করছে।

 ছাত্রলীগের নেতাদের কেউ কেউ আবার মনে করছেন, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ কিংবা অন্যান্য সহযোগী সংগঠনে অতীতে প্রগতিশীল চিন্তা ও চর্চা যতটা কঠোরভাবে মানা হতো, এখন তা কিছুটা আলগা হয়ে গেছে। এ জন্যই ইসলামপন্থীরা সহজে দলের বিভিন্ন স্তরে জায়গা করে নিতে পারছে। 

অবশ্য আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, তাৎক্ষণিক বহিষ্কার করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেলেও এটাকে সংগঠনের একটি দুর্বলতা হিসেবেই দেখা হচ্ছে। এই ঘটনা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। কারণ, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ বরাবরই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শিক রাজনীতির কথা বলে আসছে। সাঈদীর প্রতি সহানুভূতিশীল কেউ ছাত্রলীগে আছে—এই ঘটনা চেতনা ও আদর্শের রাজনীতির ওপর কিছুটা হলেও কালি ফেলেছে।

ছাত্রলীগের একটি সূত্র জানায়, ৩১ আগস্ট সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। ওই দিন সারা দেশ থেকে বিপুল সংখ্যায় নেতা-কর্মীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা হবে। এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত সাঈদীর প্রতি সংগঠনের বিভিন্ন ইউনিটের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সহানুভূতি প্রকাশ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। ওই দিন প্রধানমন্ত্রী হয়তো ছাত্রলীগে ‘অনুপ্রবেশ’ নিয়ে দিকনির্দেশনা দিতে পারেন।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন এবং এস এম কামাল হোসেন দুজনই গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেন, ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ে সুবিধাবাদীর অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এখন সব স্তরে নেতা নির্বাচনের সময় বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে থাকা অনেকে পরবর্তী সময়ে বিএনপিতে যোগ দিয়ে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যও হয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দলবদল নতুন কিছু নয়। তবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত একজনের মৃত্যুতে আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের পদধারী নেতাদের শোক প্রকাশ করাকে অন্যায় হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ জন্যই ত্বরিত বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে টাকাপয়সা নেওয়ার অভিযোগও বিভিন্ন সময় উঠেছে। কমিটিতে স্বজনপ্রীতির অভিযোগও ব্যাপক। নানা উপদলীয় কোন্দলের কারণে দল ভারী করতে বাছবিচার না করেই পদপদবি দেওয়া হচ্ছে। এখন শুধু ছাত্রলীগ নয়, আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য সহযোগী সংগঠনেও শুদ্ধি অভিযান চালানোর কথাও এর আগে অনেকবার বলা হয়েছে; কিন্তু তা কর্যকর হয়নি।

কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের হয়ে চারজন নেতা ছাত্রলীগের দেখভালের দায়িত্বে আছেন। এর অন্যতম আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। এই বিষয়ে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, যুদ্ধাপরাধী-রাজাকার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর প্রতি সহানুভূতিশীল এমন কেউ ছাত্রলীগের নেতা দূরে থাক, সাধারণ সদস্য হওয়ারও যোগ্যতা রাখে না। এমন মনোভাবাপন্ন আরও যদি কেউ ঘাপটি মেরে থাকে, তাদেরও খুঁজে সংগঠন থেকে বের করে দিতে হবে। তিনি দাবি করেন, জামায়াত ও সাম্প্রদায়িক শক্তির অব্যাহত অপপ্রচার দ্বারা কেউ কেউ প্রভাবিত হতে পারে। তবে তারা সবাই সুযোগসন্ধানী, হাইব্রিড। ছাত্রলীগে তাদের জায়গা নেই।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ ইসলামবিরোধী শক্তি-এমন একটা অপবাদ দীর্ঘদিন ধরেই চলছিল। ফলে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার সময় ধর্মীয় নানা বিষয়ে কিছুটা ছাড় দিয়ে চলতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। বিশেষ করে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সখ্য এর অন্যতম উদাহরণ।

এ ছাড়া সারা দেশে মডেল মসজিদ স্থাপন, কওমি শিক্ষাকে স্বীকৃতিদানও রয়েছে। ফলে দলের ভেতর ধর্মভিত্তিক একটা প্রভাব বেড়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের অন্য শরিকেরা বারবারই এই বিষয় তোলার চেষ্টা করেছে।

আওয়ামী লীগের নেতাদের কেউ কেউ মনে করেন, অনুপ্রবেশকারীর পাশাপাশি দলের ভেতরে ইসলামি বা ধর্মভিত্তিক নীতির প্রভাব বৃদ্ধির কারণেও যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পরও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ছাত্রলীগের কেউ কেউ ‘কোরআনের পাখি’ পরিচয় দেওয়ারও চেষ্টা করেছেন।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা তথা সব ধর্মের সম-অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং সমাজতন্ত্র তথা শোষণমুক্ত সমাজ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মূলনীতি।’ আর গঠনতন্ত্রে দলটির অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়িয়া তোলা।’ 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, আদর্শিক অবস্থান থেকে অনেকটা সরে যাওয়ার যে অভিযোগ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে উঠছে, দলটির উচিত সেই অভিযোগকে এখনই গুরুত্ব দিয়ে পর্যালোচনা করা।

এম.এস.এইচ/

ছাত্রলীগ দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী আওয়ামী লীগ

খবরটি শেয়ার করুন