শুক্রবার, ১৩ই সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২৯শে ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পলিথিন নিষিদ্ধ হলেও ব্যবহার চলছেই!

বিশেষ প্রতিবেদক

🕒 প্রকাশ: ০৫:৩৫ অপরাহ্ন, ২১শে আগস্ট ২০২৪

#

ছবি: সংগৃহীত

নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব দেশ। মুদি দোকান থেকে শুরু করে বাজারে মাছ, মাংস, ডিম, শাক-সবজি, ফলমূল যে কোনো পণ্য বিক্রিতে সঙ্গে দেয়া হচ্ছে পলিলিথিনের ব্যাগ। এর উৎপাদন, বিপনন ও ব্যবহার বেড়েই চলেছে। ফলে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, ক্ষতি হচ্ছে কৃষি জমির। পাশাপাশি হুমকির মুখে পড়ছে জনস্বাস্থ্য। এছাড়া পলিথিনে তলদেশ ভরাট হয়ে নদী হরাচ্ছে তার স্বাভাবিক প্রবাহ।  

আইনী দুর্বলতার সুযোগে পরিবেশ বিপর্যয়ের এই উপাদান এখন রাজধানীসহ সারাদেশেই সহজলভ্য। অপচনশীল সর্বনাশা পলিথিনের যত্রতত্র ব্যবহারের ফলে ভরাট হচ্ছে নগর-মহানগরের পয়োনিষ্কাশনের নালা-নর্দমা। ভেঙ্গে পড়ছে ড্রেনেজ ব্যবস্থা। পলিথিন বর্জ্যের কারণে উর্বরতা হারাচ্ছে মাটি। ভরাট হচ্ছে খাল-বিল-নদী, দূষিত হচ্ছে পানি। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর কোতোয়ালি, সূত্রাপুর,  চকবাজার, চানখাঁরপুল, ইসলামবাগ, লালবাগ, ইমামগঞ্জ, আরমানিটোলা, দেবীদাস লেন, সোয়ারিঘাট, মিরপুর, তেজগাঁও, কামরাঙ্গীরচর, জিঞ্জিরা ও টঙ্গীতে পলিথিন কারখানা রয়েছে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য এলাকায়ও পলিথিন উৎপাদন হয়। 

সূত্র জানায়, সারাদেশে এখনও এক হাজারের বেশি পলিথিন কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে খোদ রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশেই রয়েছে প্রায় ৫শ’পলিথিন উৎপাদনের কারখানা। পরিবেশ অধিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার বন্ধে মাঝে মাঝে অভিযান চালিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জরিমানা করে ও কারাদন্ডও দেয়। তবুও পলিথিন ব্যবহার বন্ধ হয় না। আইনের কঠোর প্রয়োগ না করায় অভিযানের কয়েকদিন পরেই আবারও স্বাভাবিকভাবেই চলে উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার। 

পরিবেশ সংরক্ষণের স্বার্থে ২০০২ সালে পলিথিন শপিং ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে সরকার। এছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পলিথিনে তৈরি সব ধরণের শপিং ব্যাগ উৎপাদন আমদানি, বাজারজাত, বিক্রি ও বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুত-বিতরণ নিষিদ্ধ। এর ব্যত্যয় হলে জেল জরিমানার বিধান রয়েছে। অথচ এ আইন লঙ্ঘন করেই প্রশাসনের নাকের ডগায় বাজারগুলোতে অবলীলায় বিক্রি হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ। 

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সারাদেশে নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরীর কারখানা রয়েছে কমপক্ষে ১৫০০। এরমধ্যে পুরান ঢাকা এবং বুড়িগঙ্গার তীর ঘেষে রয়েছে কমপক্ষে ৫ শতাধিক কারখানা। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে প্রতিদিন কোটি কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার শেষে ফেলে দেয়া হয়। ফেলে দেয়া পলিথিন ব্যাগের একটা বিরাট অংশ কোনো না কোনোভাবে নদীতে গিয়ে পড়ছে। দীর্ঘদিন ধরে নদীর তলদেশে পলিথিনের পুরুস্তর জমেছে। এতে নদী তার স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়ে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। 

পরিবেশবাদিরা বলছেন, অনেক দেশ আইন করে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে স্থলের পর এবার নদী-সাগরকে বিষিয়ে তুলেছে বিষাক্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক। তারপরও সচেতনতা বাড়ছে না। মানুষ, প্রাণি ও পরিবেশকে  রক্ষা করতে পলিথিন ও ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। তারা বলছেন, পলিথিন নিষিদ্ধ হওয়ার পরও সারাদেশে চলছে এর অবাধ ব্যবহার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনেই রাজধানীসহ সারাদেশেই চলছে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার। আবার পুরানো পলিথিন পুড়িয়ে তৈরি করা হচ্ছে নতুন পলিথিন। এতে মারাত্মকভাবে বায়ু দূষন হচ্ছে। পলিথিন পোড়ালে কার্বন মনো-অক্সাইড তৈরি হয়ে বাতাস দূষিত করে। এদিকে পলিথিনের জন্য সমুদ্রের জীববৈচিত্রেও পরেছে ঝুঁকির মুখে।

এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি বছর ৮৭ হাজার টন, ওয়ান টাইম পলিথিন ও প্লাস্টিক বাংলাদেশে ব্যবহৃত হয়। একবার ব্যবরহারযোগ্য প্লাস্টিকের মধ্যে রয়েছে প্লস্টিক স্ট্র, কটনবাড়, ফুড প্যাকেজিং, ফুড কনটেইনার, বোতল, প্লেট, প্লাস্টিক চামচ, কাপ, প্লাস্টিক ব্যাগ, পেস্ট, শ্যাম্পুর প্যাকেট ইত্যাদি। মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার ও বর্জ্য অব্যবস্থাপনার কারণে এসব প্লাস্টিক কৃষিজমি, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, নদী-নালা, খাল-বিল ও সমুদ্রে পতিত হয়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। 

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে বছরে এখন ৮ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর ৪০ শতাংশ, অর্থাৎ ২ লাখ ২৮ হাজার টনের মতো পুনর্ব্যবহার (রিসাইকেল) হয়। বাকি বর্জ্য পরিবেশে পড়ে থাকে। রাজধানীতে বছরে প্রায় আড়াই লাখ টন, অর্থাৎ দিনে ৬৮১ টনের মতো বর্জ্য উৎপন্ন হয়। সারাদেশে দিনে এর পরিমাণ ২ হাজার ২৫০ টন। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী সারাদেশের মানুষ বছরে মাথাপিছু ৯ কেজি বর্জ্য উৎপন্ন করলেও রাজধানীতে এটি দ্বিগুণ অর্থাৎ ১৮ কেজি। 

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাজধানীর ড্রেনেজ সিস্টেমে জ্যাম লাগিয়ে রাখা আবর্জনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যার কারণ পলিথিন। পলিথিনের কারণে অন্য সব আবর্জনাও জট পাকিয়ে থাকে। তাই নগরবাসী যখন অপচনশীল পলিথিন রাস্তায় ফেলছেন, তা বহুবছর কোন না কোন ড্রেনে আটকে থাকে কিংবা বুড়িগঙ্গানদীসহ আশপাশের কোন জলাশয়ে গিয়ে জমে থাকে। এ কারণেই পলিথিন বর্জ্যে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের জলাশয়গুলো ভয়াবহ দূষণের শিকার হয়েছে। 

বৈশ্বিক মোট প্লাস্টিক দূষণের ২ দশমিক ৪৭ শতাংশ বাংলাদেশে হয় উল্লেখ করে টিআইবি বলছে, পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করে আইন করা হলেও কার্যকর প্রয়োগের অভাবে প্লাস্টিক থেকে পরিবেশদূষণ শুধু অব্যাহতই নয়, বরং উদ্বেগজনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। 

প্লাস্টিক বর্জ্যসহ ব্যাপকভাবে বর্জ্য ফেলার কারণে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও কর্ণফুলী নদী বাংলাদেশের অন্যতম দূষিত নদীতে পরিণত হয়েছে। প্লাস্টিক দূষণের কারণে আমাদের বাস্তুতন্ত্র এবং ভূমির ব্যাপক দূষণ ঘটায় গাছপালা ও অন্যান্য প্রাণীর অস্বিত্ব আজ হুমকির সন্মুখীন।  

সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট এক তথ্য অনুযায়ী, সব মিলিয়ে তিনটি পরিবেশ আদালতে বর্তমানে ৩৬৫ মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে ঢাকায় ১১৩ ও চট্টগ্রামে রয়েছে ২৪৩ মামলা। পরিবেশ আপিল আদালতে বিচারাধীন ৯টি মামলা। পরিবেশ-সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা কম থাকায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের ওই দুটি পরিবেশ আদালতে অন্য আইনে করা মামলারও বিচার চলছে। প্রায় আড়াই হাজার মামলা বিচারাধীন ওই দুই আদালতে।

পরিবেশ আদালত ছাড়াও স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত পরিবেশ-সংক্রান্ত মামলার বিচার করে। পরিবেশ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী দেশের আট বিভাগীয় স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বর্তমানে বিচারাধীন ৬৬৯ মামলা। অন্যদিকে উচ্চ আদালতে পরিবেশ-সংক্রান্ত ১ হাজার ৩৫৪টি রিট বিচারাধীন। অবশ্য বিচারিক আদালতের বাইরে পরিবেশ অধিদফতর থেকেও ভ্রাম্যমাণ (মোবাইল) আদালতের মাধ্যমে পরিবেশ সুরক্ষায় অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়। তবে এসব উদ্যোগের পরও পরিবেশদূষণ কোনোভাবেই কমছে না।

এদিকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বুধবার (২১শে আগস্ট) সচিবালয়ে নিজ দফতরে গণমাধ্যমকে বলেন, আপনি যে দোকানে যান সে দোকান থেকে পলিথিন ব্যাগে করে পণ্য আনেন। আমি, আপনি কেউ বলিনা পলিথিন ব্যাগ দিচ্ছেন কেন, এটা তো নিষিদ্ধ। আমরাও তো হাতে করে নিয়ে আসি। মার্কেটগুলোতে গিয়ে প্রথমে আমরা বলবো ১৫ থেকে ২০ দিন। তারপর আমরা অভিযানে যাবো। 

কবে থেকে অভিযান শুরু হবে- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এর তারিখ নির্ধারিত হয়নি। কারণ এর সঙ্গে আরও কয়েকটি সংস্থা সম্পৃক্ত। এখন সবাই একটা আন্দোলনের মুডে আছে। সবাই সবার দাবি পেশ করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ওইদিকে ব্যস্ত আছে। তবে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই আপনারা কার্যক্রমের শুরু দেখতে পারবেন। 

কেবি/

                                               



পলিথিন

খবরটি শেয়ার করুন