মঙ্গলবার, ২৭শে আগস্ট ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১২ই ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কোটা বহাল বা বাতিল এখন আদালতের বিষয়

উপ-সম্পাদকীয়

🕒 প্রকাশ: ১২:৪৫ অপরাহ্ন, ১৪ই জুলাই ২০২৪

#

সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বহাল কিংবা বাতিল কি আসলেই আদালতের নাকি সরকারের বিষয়? সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ গত ১০ই জুলাই এক আদেশের মাধ্যমে আপাতত ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের সরকারি পরিপত্রটি পুনর্বহাল করেছেন। কিন্তু অনেকেই মনে করেন যে কোটা বহাল বা বাতিলে আদালতের করণীয় কিছুই নেই। এই যেমন কোটা সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সম্প্রতি একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, কোটা বহাল বাতিল আদালতের এখতিয়ারভুক্ত নয়। তারা মূলত সরকারের নির্বাহী বিভাগের কাছ থেকেই কোটা সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান চান। আবার একজন দৈনিক প্রথম আলোতে একটি বিশ্লেষণ লিখে বলেই ফেললেন যে কোটা রাখতে কিংবা বাতিল করতে বলা কোনোটিই আদালতের মীমাংসার বিষয় নয় (প্রথম আলো, ১০ই জুলাই, ২০২৪)। এ ধরনের বক্তব্য বা প্রবন্ধ জনমনে, বিশেষ করে আন্দোলনরত ছাত্রদের বিভ্রান্ত করতে পারে। তাই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের এখতিয়ার প্রসঙ্গে সংবিধান কী বলছে সে প্রসঙ্গে আরো আলোচনা করা প্রয়োজন।     

প্রথমত, মৌলিক অধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনও বিষয়ের সাংবিধানিকতা যাচাই করার অধিকার সর্বোচ্চ আদালতের রয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হলো সবার জন্যে আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করা। সে উদ্দেশ্যে সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বিভিন্ন মৌলিক অধিকার সন্নিবেশিত হয়েছে। এ ভাগের বৈশিষ্ট্য হলো যে এতে বর্ণিত অধিকারসমূহ বাস্তবায়ন করতে সরকার বাধ্য এবং তা আদালতের মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায়। সংবিধানের তৃতীয় ভাগের অনুচ্ছেদ ২৮ ও ২৯ অনুযায়ী রাষ্ট্র চাইলে নাগরিকদের মধ্যে পিছিয়ে পড়া কোনও অংশকে প্রজাতন্ত্রের কোনও কাজে অংশগ্রহণের বিশেষ সুযোগ দিতে পারে। একেই আমরা কোটা ব্যবস্থা বলি। যেহেতু সংবিধানে এ অনুচ্ছেদদ্বয় মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত এবং আইন দ্বারা বলবৎযোগ্য তাই রাষ্ট্র কোনও অনগ্রসর অংশের নাগরিকগণকে কোটা না দিলে বা কোটা থেকে অহেতুক বাদ দেয়া হলে সেই অংশের মানুষ আদালতের মাধ্যমে তা দেয়ার বা পুনর্বহালের আবেদন করতে পারেন। কাজেই কোটা বহাল বা বাতিলে আদালতের যে একটি ভূমিকা রয়েছে তা অনস্বীকার্য। এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, সংবিধান নিয়ে যারা নিয়মিত চর্চা করেন তারা জানেন সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ের ব্যাখ্যা সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সাহায্য করতে হবে। অর্থাৎ ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদ ব্যাখ্যা করতে গেলে আমাদেরকে অবশ্যই দ্বিতীয় অধ্যায়ের অনুচ্ছেদ ১০ (সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তি), ১৪ (কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তি) ও ১৯ (সুযোগের সমতা) বিবেচনায় নিতে হবে। অনুচ্ছেদ ১৯(১)-এ বলা হয়েছে যে, সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হবে। অনুচ্ছেদ ১৯(২)-এ মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপের জন্যে নাগরিকদের মধ্যে সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার নিমিত্তে এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে - এই কথা বলা হয়েছে। সবশেষে অনুচ্ছেদ ১৯(৩) জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা নিশ্চিত করবার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে দিয়েছে। অনুচ্ছেদ ১৯ বিবেচনায় নিলে অনুচ্ছেদ ২৮ ও ২৯ এর যে বিশদ ব্যাখ্যা প্রয়োজন তা সংসদ নয় একমাত্র আদালতই দিতে পারে। 

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের সংবিধানের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সাংবিধানিক প্রাধান্য (অনুচ্ছেদ ৭)। অর্থাৎ, সংবিধানই প্রধান, সংসদ নয়। সংবিধানের ৭ নং অনুচ্ছেদে আরো বলা হয়েছে কোনও আইন যদি সংবিধানের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তাহলে যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হবে। সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদ জাতীয় সংসদকে আইন প্রদানের ক্ষমতা প্রদান করেছে। ১৯৮৯ সালের সংবিধান সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করা প্রথম মামলা আনোয়ার হোসেইন চৌধুরী বনাম বাংলাদেশে বলা হয়েছিলো, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদ কখনোই সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সাথে সাংঘর্ষিক কোনও আইন তৈরি করতে পারবে না, এমনকি এভাবে সংবিধানও সংশোধন করা যাবে না। অর্থাৎ কোনও আইন বা কোনও কাজ সংবিধানের চৌহদ্দি লঙ্ঘন করলে সুপ্রিম কোর্ট সেটিকে অসাংবিধানিক বিধায় বাতিল করতে পারবে। সে কারণেই সুপ্রিম কোর্ট ২০১৮ সালের কোটা বাতিলে জারি করা পরিপত্রের সাংবিধানিকতা যাচাই করতে পারেন। ৭নং অনুচ্ছেদটি সংবিধানের প্রথম ভাগে রয়েছে এবং এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ। তাই কোনভাবেই এর ব্যত্যয় ঘটানোর সুযোগ নেই।

তৃতীয়ত, কোটা থাকবে কী থাকবে না, থাকলে কার জন্য থাকবে, এই বিষয়গুলো যে অবশ্যই জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট- এ কথাটা নিশ্চয়ই কেউ অস্বীকার করবেন না। একটু বলে নেওয়া প্রয়োজন, সাধারণ অর্থে জনস্বার্থ হলো জনসাধারণের জন্য কল্যাণকর কোনও কাজ। জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট মামলার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ার আমাদের সাংবিধানিক আইনের অংশ। যে আদেশের বলে ২০১৮ সালের পরিপত্রটি পুনর্বহাল হলো সেটি একটি জনস্বার্থমূলক মামলার আদেশ। ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের পরিপত্রটির মাধ্যমে রাষ্ট্র সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে তাদের বিশেষ সুবিধা কেড়ে নিয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করার এখতিয়ার বাংলাদেশের সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীনে আদালতের রয়েছে। সুতরাং এই জনস্বার্থ মামলায় আদালতের সিদ্ধান্ত দেয়ার অধিকার আমাদের রাষ্ট্রে অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন হঠাৎ করে বলে দিলেই হবে না যে কোটা সংস্কারের বিষয়টি আদালতের এখতিয়ারে নেই, এটি সরকারের নির্বাহী বিভাগের একক এখতিয়ারের বিষয়।  

কোটা প্রসঙ্গে উপরে উল্লেখিত প্রথম আলোর বিশ্লেষণে সংবিধানের ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদদ্বয়ের সাথে ৫৯ অনুচ্ছেদের তুলনা করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, সংবিধান ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে দেশের অনগ্রসর অংশের জন্যে বিশেষ বিধান সৃষ্টি করার অধিকার দিয়েছে। তবে রাষ্ট্র অবশ্যই এ ধরনের বিধান তৈরি করবে এমনটা বলা হয়নি। অপরদিকে, ৫৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে সংসদ আইন তৈরি করে স্থানীয় প্রশাসনের মাঝে বিভিন্ন ক্ষমতা বণ্টন করতে পারে। প্রথম আলোতে লেখক দাবি করেছেন ৫৯ অনুচ্ছেদের বিষয়ে আদালত যেমন সরকারকে আইন প্রণয়নে বাধ্য করতে পারে না, তেমনি  ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদের বিশেষ সুবিধা প্রদান, সংস্কার বা বাতিলের ক্ষেত্রে আদালত সরকারকে বাধ্য করতে পারবে না। এই বক্তব্যটি সম্পূর্ণভাবে বিভ্রান্তিকর। 

আইনের একটি সহজ পাঠ হলো, কোনও আইনের একটি অনুচ্ছেদের অর্থ বোঝার ক্ষেত্রে আইনটির  প্রস্তাবনা, সেই অনুচ্ছেদটি যে ভাগের অংশ সে ভাগের শিরোনাম, সে ভাগের উদ্দেশ্য, এর চৌহদ্দি এবং সাংবিধানিক গুরুত্ব বিবেচনা করা আবশ্যক। ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদ সংবিধানের তৃতীয় ভাগের অংশ, এ ভাগের শিরোনাম “মৌলিক অধিকার” এবং এটি আইন দ্বারা বলবৎযোগ্য। আগেই উল্লেখ করেছি যে সংক্ষুব্ধ অনগ্রসর অংশের জনগণ আদালতে ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদের বিশেষ সুবিধার জন্যে মামলা করতে পারেন। যদি সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির দাবি আইনসম্মত মনে হয় তাহলে আদালত সরকারকে সে বিষয়েও নির্দেশনা দিতে পারেন। অর্থাৎ আদালত বলতে পারেন যে, যারা বিশেষ সুবিধা দাবি করছে তারা আদৌ অনগ্রসর অংশ কিনা বা বিশেষ সুবিধা পাওয়ার অধিকার আছে কিনা। অন্যদিকে সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ চতুর্থ ভাগের তৃতীয় পরিচ্ছদের অংশ। এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামো নয়, এবং সংসদ এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইন তৈরি না করলে কাউকে মামলা করার অধিকার দেয়া হয়নি। এটির ক্ষেত্রে আদালত সরকারকে আইন প্রণয়নে বাধ্য করতে পারে না। সুতরাং, উল্লেখিত ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদের সাথে ৫৯ অনুচ্ছেদের তুলনা অমূলক। অতএব, এ কথা বিনা দ্বিধায় বলা যায় আদালত সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত মৌলিক  অধিকার বাস্তবায়ন দেখভাল করার জন্যে সাংবিধানিকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। 

কোটা বহাল বা বাতিলের দায়িত্ব প্রসঙ্গে একই পত্রিকায় বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, কোটার শতকরা পরিমাণ সরকারকেই নির্ধারণ করতে হবে, তা আদালত ঠিক করে দেবেন না। তবে কোটার সাংবিধানিকতা প্রশ্নে আদালতের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকতে হবে। সরকার চাইলে সুপ্রিমকোর্টের রায় অনুযায়ী ২০১৮ সালের পরিপত্রটি পুনর্বহাল করে কিছুদিন পরেই নতুন একটি পরিপত্র জারি করতে পারেন, যার মাধ্যমে কোটা সংস্কার করা হবে। তাঁর মতে, আইন করলে ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে, কারণ পরিস্থিতি সবসময় একই রকম নাও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে আইন পরিবর্তন করা অনেক কঠিন হবে। তাই পরিপত্র দিয়েই সমস্যা সমাধান সম্ভব। তিনি প্রকারান্তরে আদালতের এখতিয়ার মেনে নিয়ে রায়ের পর সরকার কী করবে তার নির্দেশনা দিয়েছেন। 

অতএব কোটা পদ্ধতি বহাল বা বাতিলের বিষয়ে আদালতের ভূমিকা যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়টি দিবালোকের মতো স্পষ্ট। তবে এটি শুধুমাত্র আদালতের কাজ নয়। প্রাথমিক কাজ অবশ্যই সরকারের। সরকার তা ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের পরিপত্র জারির মাধ্যমে করেছে। এখন দেখার বিষয় যে সুপ্রিমকোর্টের বিচারে সরকারের এই সিদ্ধান্ত কতটুকু সাংবিধানিক হয়। 

নানারকম অসমতায় নিমজ্জিত একটি দেশের সংবিধানে কোটা ব্যবস্থা তাই একটি অলঙ্কারস্বরূপ। তবে এটি কতটুকু যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্যভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে সেই বিষয় নিয়ে সাংবিধানিকভাবে আলোচনার এখতিয়ার আদালতকে দেয়া হয়েছে। তাই সেই প্রসঙ্গে কাউকে বিভ্রান্ত না করে বরং সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়া প্রয়োজন। আশা করি বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সকলে বিবেচনা করবেন। 

অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান, সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন

কেবি/

কোটা আন্দোলন

খবরটি শেয়ার করুন