শনিবার, ২৪শে আগস্ট ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
৯ই ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ

*** খুলে দেওয়া হচ্ছে কাপ্তাই বাঁধের সব গেট, জরুরি সতর্কবার্তা জারি *** ফেনীর মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ার সচল রাখতে ডিজেল ফ্রি দেওয়ার নির্দেশ *** ‘মানুষ বাঁচলে আবার জন্মাষ্টমী উদযাপন করা যাবে’ *** সাজেকে আটকে পড়া ২৬০ পর্যটককে উদ্ধার করলো সেনাবাহিনী *** বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি পাঁচ জেলায় *** মুশফিকের সেঞ্চুরি, পাকিস্তানের বিপক্ষে লিডের স্বপ্ন বাংলাদেশের *** আখাউড়া ও কসবায় পানি কমতে শুরু করেছে *** বৃষ্টি আরও কমবে, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি *** বন্যা পরিস্থিতিতে ফ্লাইট মিস করা যাত্রীরা বিনামূল্যে টিকিট রি-বুকিং করতে পারবেন *** সাকিবকে ক্রিকেট থেকে বাদ দিয়ে দেশে ফেরাতে লিগ্যাল নোটিশ

দুর্নীতি, ঋণ খেলাপ, অর্থ পাচার কি চলতেই থাকবে?

উপ-সম্পাদকীয়

🕒 প্রকাশ: ০৪:১৪ অপরাহ্ন, ১৬ই জুলাই ২০২৪

#

দেশে এখন দুর্নীতি ও ঋণ খেলাপের বিরুদ্ধে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সরকারি ও বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের তীব্র সমালোচনায় সম্প্রতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে জাতীয় সংসদও। গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের কল্যাণে দুর্নীতিবাজ কিছু ধরা পড়লেও সচেতন নাগরিকরা বলছেন প্রকৃত দুর্নীতিবাজের সংখ্যা এর চেয়েও অনেক গুণ বেশি। আর সবচেয়ে বড় বিষয়টি হলো—খুবই ছোট ছোট পদের সরকারি কর্মচারীরা, যাদের বেতন সর্বোচ্চ ২৫/৩০ হাজার টাকা হবে, তাদেরও কেউ কেউ শত কোটি টাকার মালিক। যারা অনেক উচ্চ পদে আছেন এবং দুর্নীতিবাজ হিসাবে ইতোমধ্যে দুদকের তালিকাভুক্ত হয়েছেন, তাদের সম্পদ, অট্টালিকা, শত-শত, হাজার বিঘা জমি, ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা—এগুলোর হিসাব ক্যালকুলেটরেও হয়তো ধরবে না। সুপরিচিত একজন সিনিয়র সাংবাদিক এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে বলছিলেন, সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের সম্পদের হিসাব পত্রিকায় পড়তে পড়তে তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এত সম্পদ যে, কয়েকবার দম নিয়েও তিনি পড়ে শেষ করতে পারেননি।

এরপর এনবিআরের সাবেক সদস্য মতিউর কাণ্ড, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যানের চাকরিচ্যুত গাড়ি চালক, বিসিএস প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা আবেদ আলী, চট্টগ্রাম পুলিশের কর্মকর্তা এডিসি কামরুল ও তার স্ত্রীর নামে থাকা অবৈধ সম্পদ; কাস্টমস কর্মকর্তা মোহাম্মদ এনামুল হক, কিশোরগঞ্জের সাবেক ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মো. সেতাফুল ইসলাম, খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক শওকত ইমরান—এদের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ, অবৈধ সম্পদ অর্জন—এসব শুনতে শুনতে, দেখতে দেখতে, পড়তে পড়তে মানুষ ক্লান্ত। দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) একের পর এক মামলা করতে করতে হয়রান হয়ে গেছে। এগুলো হলো খুবই সাম্প্রতিক ঘটনা।

এর আগে করোনার সময়ে প্রতারণা করে মানুষের জীবন নিয়ে খেলেছে জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা শারমিন হুসেন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদসহ আরও অনেকে। যাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। তাদের বিরুদ্ধে করোনা পরীক্ষার নামে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে আত্মসাৎ এবং করোনার পরীক্ষা না করেই ভুয়া ও জাল রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আর রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদের নাম তো এক সময় সকাল-সন্ধ্যা মানুষকে টেলিভিশনে শুনতে হয়েছে। ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় ২০২০ সালের ১৫ই জুলাই সাতক্ষীরার দেবহাটা থেকে সাহেদকে গ্রেফতার করা হয়। করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দেয়াসহ প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমন অসংখ্য দুর্নীতি এবং  দুর্নীতিবাজের ফিরিস্তি তুলে ধরা যাবে, যাদের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা হয়েছে।

আর যাদের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা হয়নি, কোনোভাবে ধরা পড়েনি, তাদের হিসাব তো বাদই। যেমন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য মতিউর রহমানের ছেলে যদি ১৫ লাখ টাকায় ছাগল কিনতে না যেত তাহলে মতিউরের অবৈধ সম্পদ এবং তার দুই স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে এবং নিজের দেশ -বিদেশে বিলাসী জীবনযাপনের খবর আড়ালেই থেকে যেত। জাতীয় সংসদে সরকারি দলের সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, দুর্নীতি দমন কমিশন, গণমাধ্যম বা রাজনীতিবিদরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা মতিউর রহমানকে চিহ্নিত করতে পারেননি। তাকে চিহ্নিত করেছে একটি বোবা প্রাণী, ছাগল। এমন মতিউর আরও আছে কি না, তা ছাগল বা অন্য কোনো বোবা প্রাণী চিহ্নিত করার আগেই সংশ্লিষ্ট সংস্থার চিহ্নিত করা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর সাবেক পিয়ন জাহাঙ্গীর আলম ৪০০ কোটি টাকার মালিক। চড়েন হেলিকপ্টারে। জানতে পেরে তাকে তিনি বের করে দিয়েছেন। যা প্রধানমন্ত্রী নিজেই সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন।

যে দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে মাস্টার্স পাস করে বিশ হাজার টাকা বেতনের একটি চাকরির (সরকারি/বেসরকারি) জন্য কত জায়গায় ধর্না দিতে হয়, কত আবেদন করতে হয়, কত কোম্পানিতে ইন্টারভিউ, ভায়বা দিতে হয়; সেখানে যখন তারা দেখেন যে একটি সরকারি অফিসের পিয়ন-দারোয়ান কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়েছে, আটতলা দশতলা বাড়ি, ফ্ল্যাট, দামি মডেলের একাধিক গাড়ি, তখন এই তরুণ প্রজন্মের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। তাই এসব কোনো একটি বা একাধিক দুর্নীতির ঘটনায় যদি দ্রুত বিচারের মাধ্যমে কঠোর এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতো তাহলে নিশ্চয়ই দুর্নীতি অনেকটা কমে আসতো।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূলে তার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘যারা অপরাধ করছে বা দুর্নীতিতে জড়াচ্ছে সে আপন কিংবা পর বিবেচনা না করে তাদের ধরতে হবে। তাদের ছাড়ব না। এক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হবে না।’ প্রধানমন্ত্রী তার চীন সফর-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমি কঠোর হয়েছি বলেই কিন্তু দুর্নীতিবাজরা ধরা পড়েছে, এটা মাথায় রাখতে হবে। এর আগে কখনও কেউ এভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান করেনি। আমি তো বলেছি আমার ‘জিরো টলারেন্স’। এর আগে জঙ্গিবাদ নির্মূল করার কথা ছিল সেটাও আমরা করেছি। কারণ এটা তো চট করে হবে না, দীর্ঘদিনের সমস্যা। এই সমস্ত জঞ্জাল দূর করতে হচ্ছে। ’তিনি বলেন, আমরা খুঁজে বের করছি বলেই কিন্তু সকলে জানতে পারছে। খোঁজ না করলে কিন্তু জানা যেত না।’

প্রধানমন্ত্রীর এই কথায় জাতি আশাবাদী হলেও পথটা অনেক কঠিন, কেননা সমস্যাটা এক দিনের নয়।

অন্যদিকে দুর্নীতি করে এবং ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচারের খবরও অহরহ আসছে। বিশ্বজুড়ে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে ঋণখেলাপিরা বড় ধরনের ছাড় পান। বাংলাদেশ ব্যাংক গত সপ্তাহে ঋণখেলাপিদের জন্য বড় একটি ছাড়ের সুবিধা ঘোষণা দিয়েছে। এখানে ঋণখেলাপিদের জন্য ডাউন পেমেন্ট হিসেবে মাত্র ১০ শতাংশ পরিশোধের বিনিময়ে সুদ মওকুফের সুযোগ দেওয়া হবে। নীতিমালা অনুসারে, খেলাপিরা তাদের ঋণ পরিশোধের জন্য সর্বোচ্চ তিন বছর সময় পাবেন। জাতীয় সংসদে যখন সুদ মওকুফের বিষয়টি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে, তখন এই উদ্যোগ 'চোখে ধুলো' দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয় বলেই মনে করছেন বিজ্ঞজনেরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে ব্যাংকগুলো ৫০৬৫ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করে। এটি আগের বছরের ১৮৫৫ কোটি টাকার তুলনায় ১৭৩ শতাংশ বেশি। সুদ মওকুফের পাশাপাশি খেলাপিদের বারবার ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগও দেওয়া হয়েছে।

ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও মালয়েশিয়াসহ অধিকাংশ দেশই ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়। বিশেষ করে যারা ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হন। যেমন, মালয়েশিয়ায় খেলাপিদের দেশ ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হয় না। চীন তাদের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি কাজের সুযোগ কমিয়ে দেয়। কোনো কোনো দেশে ঋণখেলাপির সন্তানরা ভালো স্কুলে ভর্তি হতে পারে না। কিন্তু, বাংলাদেশে ঋণখেলাপি ও তাদের পরিবারের সদস্যরা সব নাগরিক সুবিধা ভোগ করে। বাংলাদেশে খেলাপিরা সব সময় ঋণ পরিশোধে ছাড় পান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা সাধারণ নাগরিকদের চেয়ে বেশি সুবিধা ভোগ করেন।

এই বৈষম্য দূর করে বাংলাদেশে একদিন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে, বৈষম্য ও বঞ্চনামুক্ত সমাজ গঠিত হবে—এটাই সবার প্রত্যাশা।

ইব্রাহীম খলিল জুয়েল, সাংবাদিক ও লেখক

দুর্নীতি ঋণ খেলাপি ইব্রাহীম খলিল জুয়েল

খবরটি শেয়ার করুন