বুধবার, ১৭ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২রা শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ময়মনসিংহ সদর : সাহসী নৌকায় দিন বদলের গীত

নিউজ ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ০১:৪৮ অপরাহ্ন, ২৮শে ডিসেম্বর ২০২৩

#

ছবি : সংগৃহীত

শুভ্র চৌধুরী

নৌকা প্রতীক বরাদ্দ পেয়ে আওয়ামী লীগ মনোনীত ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসনের প্রার্থী মোহিত উর রহমান তার আনুষ্ঠানিকে প্রচার শুরু করেছেন ব্রহ্মপুত্র নদে ১০০টি কাগজের নৌকা ভাসিয়ে। পাশাপাশি নদের শান্ত জলে ভাসানো হয় নৌকা-মঞ্চ। সেখানে গিয়ে প্রার্থীর সাথে বসেন কৃষক, জেলে, কুমার-কামার, মুক্তিযোদ্ধা, মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পূজারী, আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা, জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়ড়সহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধিরা। 

নৌকার পক্ষে তারা ভোট চান সবার কাছে। দিনব্যাপী সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড আর দেশের গান চলতে থাকে সেই নৌকা-মঞ্চ থেকে। আয়োজনটির নামকরণ করা হয় - ‘সাহসী নৌকায় দিন বদলের গীত’। নান্দনিকতা হারানো রাজনীতির দৃশ্যপটে এই ঘটনাটি বেশ আশাজাগানীয়া। 

ইচ্ছে হলো সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলার, প্রথমেই গেলাম ‘মটকা আঁচে’। এটি তরুণদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় একটি আড্ডার জায়গা। গিয়ে দেখি ভাড়ের চায়ে চুমুকের ফাঁকে অড্ডা চলছে। বাইরের বেঞ্চেও বসেছেন অনেকেই। চা পানের ফাঁকে মুরাদ আর সাফাত নামের দু’জনের সঙ্গে কথা হল। জানতে চাইলাম, নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছেন? এরা দু’জনেই নতুন ভোটার। প্রথমবারের মত ভোট দিতে যাচ্ছেন জাতীয় নির্বাচনে। তারা বেশ উচ্ছ্বসিত। 

প্রার্থীদের ব্যাপারে জানতে চাইলাম। বললেন, ‘শান্ত ভাই (নৌকার প্রার্থী) তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়।’ বললাম, কেন? তারা বললেন, ‘আমরা উনারে দেখছি ব্রহ্মপু্ত্রের পাড়ে বসে গলা ছেড়ে গান গাইতে, সার্কিট হাউজ মাঠে ক্রিকেট খেলতে। উনি একজন ক্রীড়া সংগঠকও। বিপিএলে ময়মনসিংহের দল আনতেছেন উনি। কোভিডের সময় উনারে দেখছি ব্যাক্তিগত উদ্যোগে খাবার বিতরণ করতে। উনার নেতৃত্বের স্টাইল আমাদের ভাল লাগে।’

সেখান থেকে গেলাম ছোট বাজারে। উদ্দেশ্য কিছু ব্যবসায়ী এবং পেশাজীবী মানুষের সাথে কথা বলা। যেমনটা ভেবেছিলাম, এখানকার মানুষদের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ভিন্নতর। তাদের মতামতও তরুণদের মত এত স্পষ্ট না। একজন বললেন যে, ‘মূল প্রতিদ্বন্দ্বীতা হবে মোহিত উর রহমান শান্তর সাথে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর। পাশ থেকে আরেকজন বলে উঠলেন, এক ভাইয়ে মেয়র, অহন আরেকজনে এমপি চায়। দল নমিনেশন দেয় নাই। তাই স্বতন্ত্র দাঁড়াইছে। ট্যাকাওলা পার্টি।’ বুঝলাম যে হাওয়া এখানে গরম! 

আমরা সেখান থেকে সরে এসে কথা বললাম মোড়ে দাঁড়ানো কয়েকজন অটোচালকের সাথে। এরা শহরে অটো চালান। বাড়ি চর এলাকায়। উনারা বেশ স্পষ্ট করেই নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতার কথা বললেন। বড় অংকের টাকা দিয়ে লাইসেন্স নিয়েছিলেন কিন্তু দেখছেন বিনা লাইসেন্সের গাড়িও চলছে প্রকাশ্য। তার উপরে আছে চাঁদাবাজি। ভোটের কথায় বললেন, ‘আল্লাহ! আগেতো সবাই আওয়ামী লীগ আছিন। এখন স্বতন্ত্র গুরুপ আলাদা হইয়া গ্যাছে। হ্যাগোর আছে ট্যাকার পাওয়ার। আর প্রিন্সিপালের পুতের (শান্ত) পক্ষে মাইনষের মমতা বেশী। নিজের খাইয়া নৌকা। আমরার চরের মানুষ এইবাই (এভাবেই) দ্যাখতাছে।’

শহরের বিভিন্ন জায়গায় অন্য প্রার্থীদের পোস্টারের আধিক্য চোখ টানল। কিন্তু ভোটের দরিয়ায় নৌকার পালে হাওয়ার বেগ বেশ স্পষ্ট। এখান থেকে আমরা ছুটলাম একটা সভার দিকে যেখানে সদর আসনের নৌকার প্রার্থী মোহিত উর রহমান শান্ত বক্তব্য দিবেন। 

আমরা যখন সভাস্থলে পৌঁছালাম তখন তার বক্তৃতা প্রায় শেষের দিকে। তিনি বলছেন, ‘আমি একজন রাজনীতিবিদ। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। কিন্তু সবার আগে আমি এই সদরের সন্তান। ময়মনসিংহ আমার আবেগের নাম। আমার স্বপ্ন এই ঐতিহ্যবাহী জনপদের হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনা। আমি জানি এই কাজটি করা খুব একটা সহজ হবে না। আর সে কারণেই আমি মানুষের কাছে যাচ্ছি, তাদের বুঝাচ্ছি। তাদের সমর্থন পেলে সর্বোচ্চে চেষ্টা করব ময়মনসিংহকে স্মার্ট শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক নগর হিসেবে গড়ে তুলতে। 

বক্তব্য শেষে ছুটছেন পরবর্তী সভার দিকে। সামান‌্য কথা বলার সুযোগ হলো, জানতে চাইলাম নির্বাচনী এলাকা নিয়ে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা। তিনি বললেন, ‘আমাদের এই সদর আসনটি ময়মনসিংহ বিভাগেরও কেন্দ্র। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে গত ১৪ বছরে জেলায় কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামোসহ সব ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে।

বিভাগীয় শহরের উন্নয়নে সিটি করপোরেশন প্রশাসনকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হয় এটাই নিয়ম। কিন্তু এই মহানগরের দায়িত্ব যাদের উপর দেয়া হয়েছিল তাদের ব্যর্থতার কারণে ময়মনসিংহ সদরের বাসিন্দারা বেসিক নাগরিক সুবিধা থেকে এখনও বঞ্চিত। এই নগর তাদের সবকিছু দিলেও এখানকার মানুষ, মাটি তাদের আপন হয়ে উঠেনি কখনো। আর সে কারণেই দল আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে শেখ হাসিনার উন্নয়নকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার।

এ ব্যাপারে আমার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অপরিকল্পিত নগরায়ন রোধে কাজ করা। ২০১৮ সালে গঠিত সিটি করপোরেশনের পুরনো ২১টি ওয়ার্ডের সঙ্গে যুক্ত শহরতলির আরো ১২টি ওয়ার্ডে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো। যানজট নিরসনে সড়কগুলো প্রশস্ত করা। রেলের লেভেল ক্রসিংকে বাইপাস করে দেওয়া য়ায় কিনা এবং নগরের তিনটি মূল প্রবেশ পথে উড়াল সড়কের সম্ভাবনাকে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া। আবাসনের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করা। ই-কমার্স - বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রাশাসনিক সহযোগীতার ব্যবস্থা করা। ড্রেনেজ সিস্টেম এবং আবর্জনা ব্যবস্থাপনার জন্য সংশ্লিষ্টদের সহযোগীতা নিয়ে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া। 

ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনরোধে ব্যবস্থা নেওয়া। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শয্যা ও কলেবর বৃদ্ধি করা। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রাশাসনিক সহযোগিতার ব্যবস্থা করা। কাজের সুযোগ বাড়াতে শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে কাজ করা। সদর আসনের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রাচীন ও মুক্তিযুদ্ধের নানা নিদর্শন এবং এতিহ্যগুলোকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া। বিশেষ করে পর্যটনবান্ধব উদ্যোগগুলোকে সহায়তা দেওয়া।’

তারপর হঠাৎ থেমে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না। লোকজন বসে আছেন। আমাকে বেরোতে হবে। আপনারা যদি আজকে থাকেন, তবে রাতে বা কাল সকালে আসবেন মিন্টু কলেজের সামনে। সময় নিয়ে কথা বলা যাবে।’ বললাম যে, আমাদের পক্ষে থাকা সম্ভব না। উনিও ক্ষমা চেয়ে নিয়ে ছুটলেন পরবর্তী সভার দিকে।

রাত তখন প্রায় ৯টা। ফেরার পথে এক রেল ক্রসিংয়ের জ্যামে আটকা পড়ল আমাদের গাড়ি। পাশে তাকিয়ে দেখি আলমগীর মনসুর (মিন্টু) মেমোরিয়াল কলেজ। স্থানীয় সহকর্মীর কাছে জানতে চাইলাম এটাই সেই মিন্টু কলেজ কিনা। তিনি বললেন, হ্যাঁ, ১৯৬৯ সালে দেশব্যাপী আইয়ুব খান বিরোধী গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হন আলমগীর মনসুর মিন্টু। প্রিয় ছাত্রের স্মৃতি রক্ষার্থে, নাসিরাবাদ কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সে সময়ের তরুণ অধ্যাপক মতিউর রহমান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মিন্টু কলেজ। মতিউর রহমানের নেতৃত্বেই হানাদার মুক্ত হয়েছিল ময়মনসিংহ। সেই তরুণ অধ্যাপকই হয়ে উঠেছিলেন অধ্যক্ষ মতিউর রহমান - ময়মনসিংহের মানুষের অভিভাবক। আর মিন্টু কলেজ হয়ে উঠেছে ময়মনসিংহের প্রগতিশীল ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সুতিকাগার। মোহিত উর রহমান শান্ত সেই মতিউর রহমানেরই সন্তান।

জ্যাম কাটছে, আমাদের গাড়ি এগুচ্ছে ধীরে ধীরে। হঠাৎ একজন বয়স্ক মানুষ এগিয়ে এসে জানালা দিয়ে লিফলেট ধরিয়ে দিলেন। নৌকার লিফলেট। চেঁচিয়ে বললেন, ‘শান্ত ভাইয়ের নৌকা, বাইয়া দেইন যে’। 

এইচআ/ আই. কে. জে/ 


নির্বাচন ময়মনসিংহ

খবরটি শেয়ার করুন