ছবি: সংগৃহীত
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী সময়ে দেশের গণমাধ্যমগুলো নতুন ধরনের চাপের মুখে পড়েছে। প্রতিবেদন পক্ষে গেলে সাংবাদিকতা ‘মুক্ত’ থাকে, বিপক্ষে গেলে ‘মবের’ (উশৃঙ্খল জনতা) শিকার হতে হয়।
রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে গতকাল বুধবার (৬ই আগস্ট) সকালে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে আয়োজিত এক সংলাপে কয়েকজনের বক্তব্যে এই অভিমত উঠে আসে। ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা: অভিযোগ নিষ্পত্তি ও স্বনিয়ন্ত্রণের বিশ্লেষণ’ শীর্ষক সংলাপের আয়োজন করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)।
সংলাপে সম্মানিত অতিথি ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, গণমাধ্যমের ওপর চাপের ক্ষেত্রে এখন একটি ‘সামাজিক শক্তি’ সক্রিয় রয়েছে। সারা বিশ্বেই কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের সময় নতুন সামাজিক শক্তিগুলোর উদ্ভব ঘটে, তারা সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে এবং কখনো কখনো তা ভয়াবহ সহিংসতায় রূপ নেয়। এ দেশেও তার কিছু প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। তবে এ ধরনের ঘটনায় যে পরিমাণ সহিংসতা হয়, সৌভাগ্যক্রমে বাংলাদেশে তা হয়নি।
অধিকাংশ মিডিয়া হাউস (গণমাধ্যমের মালিক প্রতিষ্ঠান) এখন তাদের অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যের নিরাপত্তার জন্য গণমাধ্যমকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, যত দিন এই বাস্তবতা থাকবে, তত দিন প্রকৃত অর্থে স্বাধীন সাংবাদিকতা সম্ভব নয়।
সংলাপে দৈনিক মানবজমিন–এর সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে সাংবাদিকতাকে মুক্ত বলা হচ্ছে। সাংবাদিকতা মুক্ত, যদি সেটি কারও পক্ষে যায়। তবে বিপক্ষে গেলে চিন্তা আছে। তখন শুরু হয় মব ভায়োলেন্স (উশৃঙ্খল জনতার সহিংসতা)।
মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, সাংবাদিকদের অনেকেই এখন পালিয়ে আছেন, অনেকে বিদেশে চলে গেছেন, অনেকে মামলায় জর্জরিত। এর কারণ রাজনীতি। অসুস্থ রাজনীতি সাংবাদিকদের গ্রাস করেছে। রাজনীতিমুক্ত না হলে সাংবাদিকতা মুক্ত হবে না। তিনি বলেন, রাজনৈতিক কারণে সরকারকে সমর্থন দেওয়া এবং সুবিধা নেওয়ার কারণেই সাংবাদিকরা চাপের শিকার হয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক এস এম শামীম রেজা বলেন, সংবিধানসংক্রান্ত যে বিস্তৃত আলোচনা হচ্ছে, সেখানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টি অনুপস্থিত। গণমাধ্যমের স্বনিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সামনে এনে সাংবাদিকদের অন্য আইনি সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হবে কী না, সে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
অধ্যাপক শামীম রেজা বলেন, সাংবাদিকদের ওপর যে অবিচার হয়, যে চাপ আসে, সেগুলো নিরসন করা হবে না, ব্যাপারটি যেন এ রকম না হয়।
গণমাধ্যমকে পুরো স্বাধীনতা দিতে হবে বলে মন্তব্য করে জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক আসিফ বিন আলী বলেন, এখন যেটা আছে, সেটা ‘অ্যাডহক ফ্রিডম’ (ক্ষেত্রবিশেষে স্বাধীনতা)। কেউ যদি সরকারের ‘প্রেস টিমের’ পরিচিত হয়, তার জন্য ‘ফ্রিডম’ আছে। আর কেউ যদি বিগত সরকারের সময় ভুল করে থাকে, এখন সাংবাদিকতা করতে চায়, তার জন্য ফ্রিডম নেই। এটার সাম্প্রতিক উদাহরণ দৈনিক জনকণ্ঠ।
জনকণ্ঠ দখল হয়েছে উল্লেখ করে আসিফ বিন আলী বলেন, এর পেছনে অ্যাক্টররা (পেছনে থাকা লোক) বিগত সরকারের সময়ও ভিন্ন নামে সক্রিয় ছিল। এখন নতুন করে সক্রিয় হয়েছেন। তিনি বলেন, এখন পরিস্থিতি জটিল। আইনের শাসন না নিশ্চিত করা হলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকবে না।
বাংলাদেশ গণমাধ্যমের মালিকানা পরিস্থিতি তুলে ধরে আসিফ বিন আলী বলেন, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে বসুন্ধরা গ্রুপের মতো একটা বড়সড় গ্রুপ পুরো মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করে জমি দখলের ব্যবসাকে বৈধতা দিতে পারে।
আরও আলোচনা
সংলাপে গণমাধ্যম নিয়ে আরও আলোচনা হয়। নানা দিক নিয়ে কথা বলেন আলোচকেরা। গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এখন সোনার পাথরবাটিতে পরিণত হয়েছে।
বর্তমান সরকারের আমলে সাংবাদিকদের চাকরি যাওয়ার বিষয়ে মাছরাঙা টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক রেজাওয়ানুল হক বলেন, ‘প্রশ্ন করার কারণে তিনজন সাংবাদিকের চাকরি গেছে। অফকোর্স এই চাকরি সরকার খায়নি। সরকার মিডিয়া হাউসকে বলে নাই যে এদের কে চাকরি থেকে বের করে দেন।… মিডিয়া হাউসের মালিক তাঁর নিজের পিঠ বাঁচানোর জন্যে নিজের থেকে চাকরি খেয়েছেন।’
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন থেকে ওয়েজ বোর্ড কীভাবে বাদ গেল, সেই প্রশ্ন তোলেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) প্রধান সম্পাদক মাহবুব মোর্শেদ। 'মব’ করার মাধ্যমে গণমাধ্যম দখল করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ প্রতিদিন–এর নির্বাহী সম্পাদক মনজুরুল ইসলাম।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন বলেন, দেশের সংবাদপত্রসংশ্লিষ্ট আইনে সাংবাদিক বা সংবাদপত্রের সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট নয়। প্রেস কাউন্সিল আইনে সীমাবদ্ধতা থাকলেও যেটুকু এখতিয়ার রয়েছে, সেটিরও বাস্তবায়ন হয় না।
সংলাপ সঞ্চালনা করেন সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের সভাপতি জিল্লুর রহমান। এতে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক রিয়াজ আহমেদ, বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল ও সদস্য মাহমুদা হাবীবা, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সোনিয়া জামান খান, সাংবাদিক জাহিদ নেওয়াজ খান, কাজী জেসিন প্রমুখ।
জে.এস/
খবরটি শেয়ার করুন