ছবি: সংগৃহীত
দেশে মামলা বাণিজ্যের ভয়ংকর চক্র গড়ে উঠেছে। গত বছরের ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগের সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে ‘স্বৈরাচারের দোসর’ আখ্যা দিয়ে দেশজুড়ে ঢালাও মামলা হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘটনা বানোয়াট। ঘটনা সম্পর্কে আসামিদের বেশিরভাগই কিছু জানেন না। একই ঘটনায় একাধিক মামলার প্রমাণও আছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি।
বাদী চেনেন না আসামিকে, আসামিরাও চেনেন না বাদীকে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বাদী নিজেও ঘটনা সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না। তাকে জোর করে বাদী বানানো হয়েছে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে দায়ের করা মামলা থেকে আসামিদের নাম কেটে দিতে মামলাবাজ চক্রের সদস্যরা কয়েক লাখ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত চাঁদা দাবি করছেন। চাঁদাবাজি, পূর্বশত্রুতা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জের ধরে মামলায় টার্গেট করে আসামি করা হচ্ছে।
দেশজুড়ে বিগত নয় মাস ধরে এভাবে ভয়ংকর চক্রগুলো ‘মামলা বাণিজ্য’ করছে। ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, ঠিকাদার ও সরকারি-বেসরকারি শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে টার্গেট করে আসামি করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও এ চক্রের সঙ্গে পুলিশের একটি অংশ জড়িত। যা পুলিশের তদন্তেই এর মধ্যে উঠে এসেছে।
মামলার এজাহারে যাদের নাম এসেছে, টাকার বিনিময়ে তাদের নাম বাদ দিতে ব্যস্ত একপক্ষ। আরেকপক্ষ ভুক্তভোগী পরিবারকে ভুল বুঝিয়ে মামলা-বাণিজ্য করছে। অন্য একটি পক্ষ ভুয়া মামলার কপি তৈরি করে ভুক্তভোগীদের গিয়ে তদন্তের ভয় দেখায়, দ্রুত টাকা দিয়ে নাম বাদ করানোর পরামর্শ দিচ্ছে। সুখবর ডটকমের সহযোগী বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে মামলার ভয়ংকর চক্রের তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে, প্রহসনমূলক মামলার কারণে প্রকৃত মামলাগুলো প্রায় ক্ষেত্রে মেরিট হারাচ্ছে এবং প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এতে বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। অনেক বাদী নিরপরাধ ব্যক্তিদের মামলা থেকে বাদ দিতে আদালতে হলফনামাও দিয়েছেন ইতিমধ্যে।
এমন পরিস্থিতিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এক অফিস আদেশে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মামলার তদন্তে উপযুক্ত প্রমাণ ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া এজাহারনামীয় আসামিকে গ্রেপ্তার না করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
আদেশে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সংক্রান্ত রুজু করা মামলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে এজাহারনামীয় আসামির সংখ্যা বেশি। এসব মামলার এজাহারনামীয়, বা তদন্তে প্রাপ্ত আসামি গ্রেপ্তারের নিমিত্তে উপযুক্ত প্রমাণসহ অবশ্যই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে গ্রেপ্তার করতে হবে।
আরও বলা হয়, উপযুক্ত প্রমাণ ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বৈষম্যবিরোধী মামলার এজাহারনামীয়, বা তদন্তে প্রাপ্ত কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার না করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
বর্তমানে ঢাকা শহরে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলার সংখ্যা কমে এলেও দেশজুড়ে এ প্রবণতা এখনো প্রকটভাবে চলমান। সেখানে সরকারের ঘোষণা থোড়াই কেয়ার করা হচ্ছে। বিভিন্ন দলের, বিশেষ করে বিএনপির একশ্রেণির নেতাকর্মী পুলিশের সঙ্গে সংঘবদ্ধ হয়ে মামলা বানিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। থানা–পুলিশের সঙ্গে এলাকার প্রভাবশালীদের একধরনের আঁতাত থাকে এবং তারা নানাভাবে মামলার তদন্ত প্রভাবিত করেন। যার কারণে নিরীহ সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত।
অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলেছেন, কোনো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকার পরও জুলাই-আগস্টসহ বিভিন্ন নিরপরাধ ব্যক্তিদের মামলায় জড়ানো হচ্ছে। দাবি করা হচ্ছে, মোটা অঙ্কের চাঁদা। এটা আইনের পরিপন্থী। এটা ওই ভুক্তভোগীর মনস্তাত্ত্বিক জগতে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। একসময় দেখা যাবে, এসব ভুক্তভোগী প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করবেন। এটা সমাজে স্থায়ী নৈরাজ্য ও অরাজকতার জন্ম দেবে।
আমরা মনে করি, এ অবস্থার অবসান হওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। মনে রাখা জরুরি, ঢালাও মামলা হলে কেবল নিরীহ মানুষই হয়রানির শিকার হন না, অপরাধের বিচারের পথও রুদ্ধ হয়ে যায়।
এইচ.এস/
খবরটি শেয়ার করুন