ছবি: সংগৃহীত
ক্ষমতাসীনেরা যে বাগাড়ম্বর করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও এর পরের ইতিহাস মুছে দেওয়ার 'রাজনৈতিক প্রকল্প' হাতে নিয়েছেন, সেটা জাতির জন্য আত্মঘাতী হবে বলে মনে করেন বিশিষ্ট সাংবাদিক মাহফুজ আনাম। তিনি বলেন, সরকারের এ 'প্রকল্প' বাস্তবায়ন হলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গোষ্ঠীগুলো লাভবান হবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংবিধান সংশোধনে একাধিক প্রস্তাবনা অন্তর্ভুক্ত করে যে জুলাই সনদ প্রণয়ন করেছে, এর কিছু প্রস্তাবনার শুধু বিরোধিতা নয়, সেগুলোর জন্য তিনি 'তীব্র প্রতিবাদ' জানিয়েছেন।
মাহফুজ আনাম গত বছরের জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের গঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মধ্যে ‘ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা’ দেখেছিলেন। তবে গঠিত হওয়ার প্রায় পাঁচ-ছয় মাস পর নবীন রাজনৈতিক দল এনসিপির বিষয়ে তার পর্যবেক্ষণে অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। দলটির জনপ্রিয়তা ও কার্যক্রম নিয়ে তিনি সন্দিহান। তিনি এনসিপির উদ্দেশ্যে বলেন, 'এই দাবি বা ওই দাবি পূরণ না হলে নির্বাচন হতে পারে না'—এমন কথা বলার অধিকার কোনো দলেরই নেই।
তার মতে, শেখ হাসিনাকে (গত বছরের ৫ই আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত) উৎখাতের সাফল্য দিয়ে এনসিপির বর্তমান জনসমর্থন পরিমাপের সুযোগ নেই। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এনসিপি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রণীত 'জুলাই সনদ' বাস্তবায়নের যে দাবি তুলেছে, তাদের এই দাবি অসাংবিধানিক আবদার। এটা একটি বিপজ্জনক নজির তৈরি করবে। দলটির নেতারা জনস্বার্থের বদলে দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছেন।
গত ২৯শে আগস্ট 'অ্যা ডেঞ্জারাস সাজেশন' এবং ২২শে আগস্ট 'পলিটিক্যাল পার্টিস মাস্ট সাপোর্ট দ্য ইলেকশন ড্রাইভ' শিরোনামে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত দুটি উপসম্পাদকীয়তে মাহফুজ আনাম এসব কথা বলেন। তার লেখাগুলো নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানামুখী আলোচনা চলছে নেটিজেনদের মধ্যে।
নিজেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের 'আজীবন শুভাকাঙ্ক্ষী' ঘোষণা দেওয়া মাহফুজ আনামের সরকারপ্রধানের প্রতি সমর্থন এক বছরের সরকার পরিচালনার পর আরো বেড়েছে। ডেইলি স্টারে গত ২২শে আগস্টের উপসম্পাদকীয়তে তিনি এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের প্রতি ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের সমালোচনা এখনো আগের মতোই কঠোর, বিএনপির প্রতি তার সন্দেহ গত এক বছরে বেড়েছে। জামায়াতের বিষয়ে তার মন্তব্য 'সহনশীল'।
তিনি ২৯শে আগস্টের কলামে বলেন, ''ক্ষমতাসীনেরা যে বাগাড়ম্বর করে আমাদের গ্রাস করতে চাইছেন, তা হলো—অতীতের সব, বিশেষ করে '৭১ এর পরের ইতিহাস একটি বড় ভুল বা ভীষণ বিকৃত এবং সেগুলোর পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন। এটা যদি বুদ্ধিবৃত্তিক যাত্রা হয়, তাহলে আমরা সবাই উপকৃত হবো। কিন্তু যদি এটা রাজনৈতিক প্রকল্প হয়, তাহলে সেটা হবে আত্মঘাতী।'
তিনি বলেন, ''যারা এখনো বাংলাদেশকে বিশ্বাস করে না, শুধু তারাই এর ক্ষতির বাইরে থাকবে। কিছু বক্তা নিজেদের 'সত্যের' অভিভাবক মনে করেন এবং তাদের প্রশ্ন করতে চাইলেই সেটাকে দেখা হয় অতীতকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা হিসেবে। যার মাধ্যমে মুক্তচিন্তা, সমালোচনামূলক মূল্যায়ন ও অন্বেষণের ইচ্ছাকে নিরুৎসাহিত করা হয়।"
মাহফুজ আনাম বলেন, 'একটি দল বিশ্বের সবচেয়ে সেরা আদর্শ উপস্থাপন করতে পারে, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত নির্বাচনের মাধ্যমে জনসমর্থনের পরীক্ষায় অংশ না নেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী বলা যাবে না।... যার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত জাতীয় নাগরিক পার্টি।'
তিনি বলেন, 'জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দলটির জন্ম। শেখ হাসিনার স্বৈরশাসন উৎখাতে পুরো জাতি তাদের পেছনে দাঁড়িয়েছিল। জনগণ সম্পূর্ণরূপে তাদের সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু সেটা ছিল একটি নির্দিষ্ট কাজের জন্য—আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরানো। কিন্তু এখন তারা তাদের মতাদর্শ ও জাতীয় লক্ষ্য নিয়ে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছে। হাসিনাকে উৎখাতের সাফল্য দিয়ে তাদের বর্তমান জনসমর্থন পরিমাপের সুযোগ নেই।'
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংবিধান সংশোধনে প্রণীত 'জুলাই সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার' প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, "অঙ্গীকারনামার চতুর্থ দফায় বলা হয়েছে, 'এর বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা, কিংবা জারির কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না।' আমরা এই অনুচ্ছেদের তীব্র প্রতিবাদ জানাই। গণতন্ত্রে সংবিধানের কোনো ধারাই দেশের বিচার বিভাগের আওতার বাইরে থাকতে পারে না। এটাই হয়ে উঠতে পারে সবচেয়ে অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী ও দমনমূলক ধারা।"
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের ‘আজীবন শুভাকাঙ্ক্ষী’ হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দেন ডেইলি স্টারের প্রকাশক মাহফুজ আনাম। গত ১৮ই এপ্রিল ডেইলি স্টারে 'আনহেলদি ইলেকশন কন্ট্রুভার্সি মাস্ট বি রিসলভড' শিরোনামে প্রকাশিত এক কলামে তিনি এ ঘোষণা দেন। দেশের আর কোনো সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের কোনো সরকারের পক্ষে কলাম লিখে এভাবে ঘোষণা দেওয়ার নজির নেই। গত এক বছরে সরকারের নানা ব্যর্থতার কারণেও ড. ইউনূসের সরকারের প্রতি মাহফুজ আনামের শুভকামনার কমতি নেই।
তিনি গত ২২শে আগস্টে প্রকাশিত কলামে লেখেন, 'নিঃসন্দেহে, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসই সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি, যিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের পদের জন্য যোগ্যতম। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের জায়গায় এখন এমন একটি নির্বাচিত সরকারের দায়িত্ব নেওয়া অপরিহার্য, যে সরকার জনগণের স্বাধীন আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ক্ষমতায় আসবে।'
খবরটি শেয়ার করুন