শুক্রবার, ৫ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২১শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অনন্য শৈলীর রংপুরের তাজহাট জমিদার বাড়ি

বিশেষ প্রতিবেদক

🕒 প্রকাশ: ০৭:৫৮ অপরাহ্ন, ২৬শে মে ২০২৩

#

ছবি: সংগৃহীত

প্রথমে তাজহাট জমিদারবাড়ি, তারপর রংপুর হাইকোর্ট। নির্মাণশৈলীর অনন্য নিদর্শন ও ইতিহাসের সাক্ষী এই স্থাপনা এখন রংপুর জাদুঘর। বাড়িটির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসে মানুষ। বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন জমিদার মান্না লাল রায়। তিনি ভারতের পাঞ্জাব থেকে এসেছিলেন। প্রথম দিকে পেশায় ছিলেন স্বর্ণকার। স্বর্ণখচিত টুপি কিংবা তাজ নির্মাণ করায় এ অঞ্চলের নাম হয়েছে তাজহাট। ব্রিটিশ শাসনামলে তিনি পুরো একটি পরগনা কিনে নিয়ে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। তার মৃত্যুর পর জমিদারির দায়িত্ব পান পুত্র গিরিধারী লাল রায়।

তাজহাটের জমিদার বংশের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন গিরিধারী লাল রায়। ১৮৯৭ সালে তার মৃত্যু হলে পুত্র গোবিন্দ লাল রায় জমিদারি লাভ করেন। জমিদার গিরিধারী লাল রায় ছিলেন প্রজাহিতৈষী ও দানশীল। এ জন্য তিনি ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ১৮৮৮ সালে রাজা, ১৮৯২ সালে রাজা বাহাদুর এবং ১৮৯৬ সালে মহারাজা উপাধিতে ভূষিত হন। এ সময়টি ছিল তাজহাটের জমিদারদের সোনালি অধ্যায়। পরে জমিদার গোবিন্দ লাল রায়ের মৃত্যু হলে তার পুত্র গোপাল লাল রায় জমিদার নিযুক্ত হন। তিনি ছিলেন এই বংশের শেষ জমিদার। তিনিও ১৯১২ সালে রাজা ও ১৯১৮ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক রাজাবাহাদুর উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে গোপাল লাল রায়ের বংশধররা ভারতে চলে যান।

৫৬ একর এলাকাজুড়ে রয়েছে এ কমপ্লেক্সটি। পূর্বমুখী দোতলা এ বাড়িটির সামনের দিকের দৈর্ঘ্য প্রায় ৭৭ মিটার। বাড়ির সামনে রয়েছে বড় একটি দালান। এতে ওঠার জন্য রয়েছে শ্বেতপাথরে আবৃত দৃষ্টিনন্দন সিঁড়ি। বাড়ির ছাদের মূল অংশে আট কোনা পিলারের ওপর অবস্থিত রেনেসাঁ গম্বুজ। তাজহাট জমিদার বাড়ির নকশা অনেকটা ইংরেজি ‘টি’ অক্ষরের মতো। বাড়িটিতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে চোখ পড়ে ১৯ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৪ মিটার প্রস্তের বিশাল হলঘরে। এর দুই দিকে রয়েছে একটি করে ঘর। ভেতরে আছে তিন মিটার প্রশস্ত টানা বারান্দা। প্রধান ফটকের উত্তর দিকের দোতলায় বিশাল একটি কাঠের সিঁড়ি রয়েছে। পুরো ভবনে আছে মোট ২২টি ঘর। বাড়িটিতে গাড়ি রাখার বারান্দা প্রায় ১০ মিটার দীর্ঘ। এর ওপরে যে ঝুল বারান্দা রয়েছে, তার ছাদ চারটি পিলারের ওপর অবস্থিত। দুই প্রান্তের বারান্দায়ও রয়েছে ত্রিকোনাকৃতির ছাদ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ভবনটির অংশবিশেষ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণের পর গোপাল লাল রায়, বর্তমানে যে ভবনটি রয়েছে, তার নির্মাণ কাজ শুরু করেন। কাজ শেষ হয় ১৯১৭ সালে। ইতালি থেকে আমদানিকৃত শ্বেতপাথর দিয়ে তৈরি করা হয় বাড়ির সামনের অংশের সিঁড়ি। ভবনের সামনে মার্বেল পাথরের একটি ফোয়ারা রয়েছে।

মার্বেলের সিঁড়ি বেয়ে জাদুঘরে উঠলেই দেখা যায়, বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী কক্ষ, যাতে রয়েছে দশম ও একাদশ শতাব্দীর টেরাকোটা শিল্পকর্ম। এখানে রয়েছে সংস্কৃত এবং আরবি ভাষায় লেখা বেশ কিছু প্রাচীন পাণ্ডুলিপি। এর মধ্যে রয়েছে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ের কোরআনসহ মহাভারত ও রামায়ন। পেছনের ঘরে রয়েছে বেশ কয়েকটি কালো পাথরের হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর প্রতিকৃতি; কিন্তু জাদুঘরের ভেতরে ছবি তোলার নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। প্রাসাদ চত্বরে রয়েছে বিশাল খালি মাঠ, গাছের সারি এবং প্রাসাদের দুই পাশে রয়েছে দুটি পুকুর। জাদুঘরে নির্দিষ্ট প্রবেশমূল্য পরিশোধ করে প্রবেশ করা যায়।

আরো পড়ুন: ঘুরে আসুন ঢাকার ৫ আর্ট গ্যালারি

জানা যায়, ১৯৮৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রাসাদটি ব্যবহৃত হয় রংপুর হাইকোর্ট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একটি শাখা বা বেঞ্চ হিসেবে। সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্য নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা সদরে বাংলাদেশের হাইকোর্ট বিভাগের আঞ্চলিক বেঞ্চ স্থাপন করেন, যার একটি রংপুরে স্থাপিত হয়েছিল। পরে, ১৯৯১ সালে এই পদ্ধতি তুলে দেওয়া হয়। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ প্রাসাদটিকে একটি সংরক্ষিত স্থাপনা তথা স্থাপত্য হিসেবে ঘোষণা করেন। ২০০২ সালে এটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়। এই জাদুঘরে ৩শ’র বেশি মূল্যবান নিদর্শন রয়েছে। প্রতিদিন দেশি ও বিদেশি পর্যটকরা এ বাড়ির সৌন্দর্য দর্শনে আসেন।

তাজহাট জমিদার বাড়ির কাস্টডিয়ান হাবিবুর রহমান বলেন, এই বাড়ি সপ্তাহে এক দিন দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ থাকে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এবং বিদেশি দর্শনার্থীও আসেন বাড়িটি দেখতে।

এম/

 

Important Urgent

খবরটি শেয়ার করুন