ছবি: সংগৃহীত
চ্যাটজিপিটি চালুর পর থেকে এক রাতও ঠিকমতো ঘুমাতে পারেননি বলে জানিয়েছেন ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান।
সম্প্রতি আমেরিকার টেলিভিশন উপস্থাপক টাকার কার্লসনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে অল্টম্যান বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক এই প্রযুক্তির ক্ষুদ্র পরিবর্তনগুলোও বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলছে—এ চিন্তাই তাকে রাতে ঘুমাতে দিচ্ছে না।
সাক্ষাৎকারের শুরুতে বিভিন্ন কারিগরি ভাষা ও সতর্ক মন্তব্যের আড়ালে নিজের উদ্বেগের কথা বললেও আধা ঘণ্টা পর অল্টম্যান খোলাখুলি বলেন, প্রযুক্তির বিশাল প্রভাব তাকে গভীরভাবে ভাবায়। অল্টম্যান ম্রিয়মাণ ভেবে হেসে বলেন, ‘চ্যাটজিপিটি চালুর পর থেকে ভালোভাবে ঘুমাতে পারিনি।’
অল্টম্যান জানান, তার উদ্বেগ কোনো ‘টারমিনেটর’ ধাঁচের দানব রোবট বা ভবিষ্যতের যুদ্ধ নিয়ে নয়, বরং প্রতিদিন তার দল যে ছোট ছোট নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়—কোন প্রশ্নে চ্যাটজিপিটি উত্তর দেবে, কোনটাতে বিরত থাকবে, কোথায় আপত্তি জানাবে বা চুপ থাকবে—এসব সিদ্ধান্তই তাকে বেশি ভাবায়।
তিনি আরও বলেন, এই ‘ছোট’ সিদ্ধান্তগুলো প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করেছে, আর সেগুলোর প্রভাব অনুধাবন করা প্রায় অসম্ভব।
অনুশোচনা নিয়ে অল্টম্যান বলেন, ‘আমরা হয়তো ঠিকই বলতে পারিনি। হয়তো আরও কিছু করা যেত।’
তিনি এ বিষয়ে আত্মহত্যার উদাহরণ তুলে ধরেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৭ লাখ ২০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে, অর্থাৎ প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১৫ হাজার। অল্টম্যানের আশঙ্কা, যদি ধরাও যায়, চ্যাটজিপিটি ব্যবহারকারীদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশও এ ধরনের মানসিক অবস্থায় ছিল, তাহলে প্রতি সপ্তাহে অন্তত দেড় হাজার মানুষ আত্মহত্যার আগে চ্যাটজিপিটির সঙ্গে কথা বলেছে।
সম্প্রতি, ১৬ বছর বয়সী অ্যাডাম রেইন নামের এক কিশোর আত্মহত্যা করলে তার বাবা-মা ওপেনএআইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে। তাদের অভিযোগ, চ্যাটজিপিটির ‘উত্তর’ তাকে আত্মহত্যার পথ দেখায়। এ বিষয়ে অল্টম্যান বলেন, ‘এটা নিঃসন্দেহে একটি মর্মান্তিক ঘটনা।’ তিনি জানান, ভবিষ্যতে যদি কোনো কিশোর চ্যাটজিপিটির সঙ্গে আত্মহত্যা নিয়ে আলোচনা করে এবং বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব না হয়, তাহলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার একটি ব্যবস্থা চালুর কথা ভাবছে ওপেনএআই।
তবে এটিকে ‘চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত’ হিসেবে নয়, একটি প্রাথমিক ভাবনা বলেই উল্লেখ করেন অল্টম্যান। কারণ, এতে ব্যবহারকারীর গোপনীয়তার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
আত্মহত্যা নিয়ে মত প্রকাশের সময় অল্টম্যান বলেন, কিছু দেশে যেখানে সহায়তাপ্রাপ্ত আত্মহত্যা বৈধ। যেমন: কানাডা ও জার্মানি। এসব দেশে প্রচণ্ড অসুস্থ কোনো প্রাপ্তবয়স্ক রোগীর কাছে হয়তো চ্যাটজিপিটি এই পথকে ‘একটি অপশন’ হিসেবে উল্লেখ করতে পারে। তবে অল্টমান জোর দিয়ে বলেন, চ্যাটজিপিটি কোনো কিছুর পক্ষ বা বিপক্ষে নয়।
সাক্ষাৎকারে বারবার উঠে আসে নিরাপত্তা বনাম স্বাধীনতার প্রশ্ন। অল্টম্যান বলেন, প্রাপ্তবয়স্কদের প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত। তবে কিছু বিষয় রয়েছে, যেখানে স্পষ্ট সীমারেখা থাকা জরুরি। যেমন: চ্যাটজিপিটি কখনোই মানুষকে বায়োওয়েপন বা জীবাণু অস্ত্র বানাতে সাহায্য করবে না।
কালর্সন এসব নীতিগত সিদ্ধান্তের নৈতিক ভিত্তি কী জানতে চাইলে অল্টম্যান জানান, চ্যাটজিপিটির মূল মডেল মানবতার সম্মিলিত মূল্যবোধ, ভালোমন্দ উভয় প্রতিফলন করে। এরপর ওপেনএআই একটি আচরণবিধি বা ‘মডেল স্পেক’ যুক্ত করে, যা দার্শনিক ও নীতিবিদদের পরামর্শে তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত তিনিই ও বোর্ড মিলে সিদ্ধান্ত নেন।
অল্টম্যান বলেন, ‘এসব সিদ্ধান্তের জন্য যে মানুষটিকে জবাবদিহি করতে হবে, সেটা আমি। তিনি যোগ করেন, তার লক্ষ্য নিজের মত চাপিয়ে দেওয়া নয়, বরং মানবজাতির গড় নৈতিক অবস্থান তুলে ধরা। তবে তিনিও স্বীকার করেন, এই ভারসাম্য কখনোই পুরোপুরি নিখুঁত করা সম্ভব নয়।’
কার্লসনের এক প্রশ্নের উত্তরে অল্টম্যান জানান, একসময় তিনি ভেবেছিলেন এআই কেবল কিছু করপোরেট গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করবে। তবে এখন তার বিশ্বাস, চ্যাটজিপিটি কোটি কোটি মানুষকে আরও সৃজনশীল ও সাহায্য করেছে। যদিও ভবিষ্যতে পরিস্থিতি পাল্টাতে পারে, সতর্কতা সব সময় জরুরি।
সাক্ষাৎকারে আরও উঠে আসে, চ্যাটজিপিটি কীভাবে মানুষের লেখার ধরনে প্রভাব ফেলছে। অল্টম্যান মজা করে বলেন, এমনকি চ্যাটজিপিটির লেখার ছন্দ বা কাঠামোও মানুষের লেখালেখিতে ঢুকে পড়ছে। তার মতে, এ ধরনের সূক্ষ্ম কিন্তু গভীর পরিবর্তনই তাকে প্রতিনিয়ত ভাবিয়ে তোলে।
অল্টম্যান বলেন, ‘আমাকে একসঙ্গে দুটি বিষয় ভাবতে হয়। একদিকে, এটা কেবল এক বিশাল কম্পিউটার, যেটি দ্রুততার সঙ্গে বড় সংখ্যাগুলো গুণ করছে—এই গাণিতিক বাস্তবতা। অন্যদিকে, এর ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা—যেটা একে শুধু উন্নত ক্যালকুলেটরের চেয়েও বেশি কিছু।’
জে.এস/
খবরটি শেয়ার করুন