শুক্রবার, ৭ই নভেম্বর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৩শে কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ

*** বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী আসামে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করছে ভারত *** জাতীয় দলে যৌন হয়রানির অভিযোগ জাহানারার, তদন্ত চান ক্রিকেটারেরা *** নির্বাচনে খরচ করার মতো টাকা নেই উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের *** নেদারল্যান্ডসের ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী রব জেটেন *** ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করা একটি দল দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে: মির্জা আব্বাস *** ক্ষমতার খেলায় শেখ হাসিনার নতুন ছক, আমরা কি টের পাচ্ছি? *** জামায়াতসহ সমমনা দলের গণভোটের দাবি নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র: মির্জা ফখরুল *** দেশের যে তিনটি রাজনৈতিক দলকে প্রধান বললেন মাহফুজ আনাম *** ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিষয়ে আলোচনায় প্রস্তুত ট্রাম্প *** ইলন মাস্ক মঞ্চে নাচলেন, সঙ্গী হলো রোবট

ক্ষমতার খেলায় শেখ হাসিনার নতুন ছক, আমরা কি টের পাচ্ছি?

উপ-সম্পাদকীয়

🕒 প্রকাশ: ০৭:০৬ অপরাহ্ন, ৭ই নভেম্বর ২০২৫

#

নওশাদ জামিল। ছবি: সংগৃহীত

নওশাদ জামিল

ঐতিহাসিক ৫ই আগস্টের আগে বাংলাদেশের অনলাইন দুনিয়া একরকম ‘বটযুদ্ধের’ ময়দান ছিল। সেখানে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা, তাদের বটবাহিনী আর মিডিয়া ইউনিট রাজত্ব করত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের প্রভাব ছিল চোখে পড়ার মতো। তারা পোস্ট দিত, মিম বানাত, ‘হা হা’ রিয়েক্টে ডুবিয়ে রাখত সবকিছু।

সময় কত দ্রুত বদলায়! এখন সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে রাজত্ব করছেন আওয়ামী লীগ ও তার বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীরা। তাদের অনেকেই তরুণ, অনেকে পুরোনো সৈনিক। এটা সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই টের পাবেন। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের পোস্ট খুললেই দেখবেন, হা হা রিয়েক্টের বন্যা বয়ে যাচ্ছে যেন। মিম, ট্রল, রসিকতা ইত্যাদি সবই এখন তাদের অস্ত্র। কেউ লিখছেন, কেউ ভিডিও বানাচ্ছেন, কেউ মঞ্চের মতো সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছেন। যেন নতুন যুদ্ধের প্রস্ততি।

আমার ধারণা, এখন অন্তত ৫০ লাখ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট সক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করছেন দেশে ও বিদেশে। সংখ্যাটা হয়তো কম-বেশি হতে পারে, কিন্তু ‘প্রভাব’ ব্যাপারটা অস্বীকার করার উপায় নেই। আশ্চর্যের বিষয়, তাদের কেউ বট নন, ফেক নন, সবাই বাস্তব মানুষ। শুধু নিরাপত্তার জন্য অনেকেই ছদ্মনাম ব্যবহার করছেন, প্রোফাইলে অন্য ছবি দিচ্ছেন। কিন্তু আবেগ, রাগ, ভালোবাসা, দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আনুগত্য ইত্যাদি সবটাই একদম বাস্তব।

এটা এখন অনেকে জানেন ও মানেনও; ড. মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের প্রেসক্রিপশনেই ক্ষমতায় এসেছেন। তার আগমন কোনো হঠাৎ ঘটনা নয়; এটি নিখুঁতভাবে পরিকল্পিত এক রাজনৈতিক প্রকল্প। এটাকেই তিনি বলেছেন ও স্বীকার করেছেন 'মেটিকুলাস ডিজাইন'।

আমরা যারা রাজনীতি একটু বুঝি, রাজনীতির টুকটাক খবর রাখি, তারা জানি, এটাই ড. ইউনূসের প্রথম প্রদক্ষেপ নয়। অনেকে বলেন, তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশে ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্যই। যার ফলে ২০০৭ সালে তিনি চেষ্টা করেছিলেন, শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়া দুজনকেই মাইনাস করে এক ‘ইউনূস টাইপ রাজনীতি’ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তখন তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন, এবার পেরেছেন। তবে তিনি আসলেই সফল হয়েছেন কি?

ক্ষমতায় আসা এক ব্যাপার, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা আরেক। ড. ইউনূসের সরকার এখনো স্থিতিশীল কোনো কাঠামো তৈরি করতে পারেনি। কোনোদিন তা পারবেও না। দেশের মানুষ তার প্রতি আস্থা হারাচ্ছে, একে-একে পশ্চিমাদেরও সমর্থন হারাচ্ছে। এটা এখন দিনের আলোর মতো স্পট যে, দেশে তার আর তেমন জনসমর্থন নেই। আমাদের দেশে রাজনৈতিক সমাজে শুধু বিদেশি সমর্থন দিয়েই ক্ষমতায় টেকা সম্ভব নয়, এটা ইতিহাস প্রমাণ করেছে বারবার।

এখন অনেকে বলেন, যদি ড. ইউনূস আমেরিকার পরিকল্পনায় ক্ষমতায় আসতে পারেন, তাহলে শেখ হাসিনা ভারত-রাশিয়ার পরিকল্পনায় ফিরতে পারবেন না কেন? এ প্রশ্নটা খুবই যৌক্তিক।

একাত্তরের ইতিহাস মনে করুন। আমেরিকা তখন পাকিস্তানের পক্ষে, কিন্তু ভারত-রাশিয়া দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশের পাশে। ইউরোপ-আমেরিকা, চীন, সৌদি আরব কি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আটকাতে পেরেছিল?

ভূরাজনীতির অক্ষ আবার ঘুরছে আজ। পশ্চিমা প্রভাব একদিকে, ভারত-রাশিয়া-চীন-ইরান ইত্যাদি ব্লক অন্যদিকে। এ ঘূর্ণির ভেতরেই  নিজের নতুন অবস্থান খুঁজছে বাংলাদেশের রাজনীতি।

বিশ্বের বড় বড় সংবাদমাধ্যম এখন শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নিচ্ছে, কেন? চিন্তা করুন, ভাবুন। এখন লিখিত সাক্ষাৎকার নিচ্ছে তারা। কিছুদিন পর নেবে ভিডিও সাক্ষাৎকার। এটা শুধু কোনো প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে ‘স্পেস’ দেওয়া নয়, এটা ইঙ্গিত। শেখ হাসিনা এখনো বিশ্বরাজনীতির ‘প্রাসঙ্গিক চরিত্র’। তার কথা শোনা হচ্ছে, তাকে বিশ্বে তুলে ধরা হচ্ছে এবং হয়তো নতুন কোনো সমীকরণ তৈরির প্রস্তুতি চলছে অনেকের অগোচরেই।

অনেকেই জানেন, এখন রাজনীতি শুধু রাস্তায় হয় না, হয় অনলাইনেও। ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স (টুইটার) ইত্যাদি অনলাইন মাধ্যমে এখন আসল লড়াই। বক্তৃতা নয়, এখন পোস্টই আন্দোলন। মিছিল নয়, এখন মিমই প্রচারণা। আর বক্তৃতার চেয়ে অনেক বেশি ভাইরাল হচ্ছে ব্যঙ্গ-রসিকতা। যে দল সোশ্যাল মিডিয়ায় উপস্থিতি ধরে রাখতে পারছে, তারাই জনমতের চালচিত্র নিয়ন্ত্রণ করছে।

এদিক থেকে আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান খুব স্পষ্ট। তারা বুঝে গেছে, ডিজিটাল দখল মানে মানসিক দখল। ৫ই আগস্টের ধকল কাটিয়ে মানুষের জনমনে আরও শক্তিশালী হচ্ছে, আরও জনপ্রিয় হচ্ছে আওয়ামী লীগ। নেপথ্যে আছেন শেখ হাসিনার পুরোনো ও নতুন সৈনিকেরাই।

এখন কেউ কেউ বলছেন, দেশে আরেকটি ‘প্রতিবিপ্লব’ শুরু হয়েছে—নীরবে, অনলাইনে, অদৃশ্যভাবে। আমি বলব, এটা শুধু প্রতিক্রিয়া নয়, এটা একধরনের রাজনৈতিক বিবর্তন। ভবিষ্যতে তা যদি হয়, আমি অন্তত মোটেও অবাক হব না।

পশ্চিমাদের এজেন্ডা যদি হয় ড. ইউনূস, তবে ভারত-রাশিয়ার এজেন্ডা কেন শেখ হাসিনা হবেন না? রাজনীতি শূন্য থাকে না, এক পক্ষ হারায়, অন্য পক্ষ উঠে আসে। সম্ভবত বাংলাদেশ এখন সেই ঘূর্ণির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে আবার নিজের রূপ পাল্টাতে যাচ্ছে ইতিহাস।

আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে 'সরকার ও রাজনীতি' বিভাগে পড়েছি, এটা জানি রাজনীতি কখনো বইয়ের ভেতর থাকে না। রাজনীতি থাকে মানুষের কথায়, ঘামে ও রক্তে, রাজনীতি থাকে বাতাসে। চায়ের স্টলে বসুন, সাধারণ মানুষের কথা শুনুন। অনেক কিছু বুঝতে পারছেন। দেশের অধিকাংশ সাধারণ মানুষ এখন প্রকাশ্যেই বলছেন, আমরা আগেই ভালো ছিলাম। তাদের কথানুযায়ী, বাংলাদেশের বাতাসে এক অদ্ভুত গন্ধ আছে—পরিবর্তনের, পুনর্গঠনের, আরেকবার ঘুরে দাঁড়ানোর।

কিছুদিন পর যদি ভারত-রাশিয়া একসুরে কথা বলে, তাহলে আমেরিকার বাপের 'ক্ষমতা' নেই কিছু বলার। আক্ষরিকভাবে ভারতের পেটের ভেতর বাংলাদেশ, অন্যদেশ এখানে বেশি সুবিধা করতে পারবে না, এটা একাত্তরে প্রমাণ হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে।

আমি জানি, অনেকে এখনো বুঝতে পারেননি আমার কথা। কিন্তু যারা বুদ্ধিমান, তারা টের পাচ্ছেন, নিজের আখের গুছিয়ে একে-একে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছেন। দেশে দৃশ্যমান সরকার যেমন আছে, তেমনি আছে অদৃশ্য প্রস্তুতি। আগামী দিনে যদি শেখ হাসিনা ফেরেন, আওয়ামী লীগ ফেরে, তাতে আমি অবাক হব না। আপনি কি অবাক হবেন?

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

নওশাদ জামিল

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন

Footer Up 970x250