ছবি - সংগৃহীত
রবিউল হক
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকনাট্য হিসেবে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন গ্রামে সর্পদেবী বা মনসা ও তার আখ্যান হিসেবে কান্দনী বিষহরির গান পরিবেশিত হয়ে থাকে। বিষহরির কান্নাকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদানের পাশাপাশি বেহুলা চরিত্র এ ধারার পরিবেশনায় প্রধানরূপে প্রতীয়মান হয়ে ওঠে।
কান্দনী বিষহরি গানের প্রচলন: ঐতিহ্যবাহী কান্দনী বিষহরির গান বা কানী বিষহরা গান পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে আজও বেশ জনপ্রিয়। “কান্দনী বা কানী বিষহরি রাজবংশী হিন্দুদের প্রাত্যহিক পারিবারিক পূজার অন্যতম প্রধান দেবী হিসেবে বিবেচ্য। সাধারণত শ্রাবণের শেষ ও ভাদ্র মাসের প্রথম দিনে কলা গাছের তৈরি ভুরা ভাসিয়ে দেয়ার মধ্যদিয়ে বিষহরা দেবীকে বিদায় জানানোর রীতি প্রচলিত”।১
বিষহরি গানের দলের বায়না: বিষহরির পালাকার সামান্য সম্মানী পেয়ে থাকেন। এর আয়োজন ও পৃষ্ঠপোষকতা গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে নিহিত থাকায় দল প্রতি ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা বায়না করা হয়ে থাকে।
পরিবেশনার সময়: হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিষহরির পালা পরিবেশিত হলেও মূলত মনসার পূজাকে উপলক্ষ্য করে বর্ষাকালে অর্থাৎ আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে এর পরিবেশনা বেশি লক্ষ করা যায়। এছাড়া গ্রামের মানুষ বিভিন্ন মানত উপলক্ষে কান্দনী বিষহরির পালা আয়োজন করে থাকে। রাত ৯টা কিংবা ১০টায় এ পালা শুরু হয়ে ঠিক পরের দিন সকাল প্রায় ১০টা পর্যন্ত পরিবেশিত হয়ে থাকে।
মঞ্চ বা আসর: কান্দনী বিষহরির গান পরিবেশনের জন্য দেড় থেকে দুই ফুট উঁচু অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করা হয় যার চার কোণে ৪টি কলা গাছ, বাঁশ বা কাঠের খুঁটি পুঁতে উপরে কাপড়, টিনের চালা বা কাপড়ের ছাউনি দেয়া থাকে। তবে মঞ্চের একদিকে সীমান্ত রেখার মাঝামাঝি অবস্থানে দুটি চেয়ার স্থাপন করা হয়ে থাকে। চেয়ার দুটির ঠিক বিপরীত দিকে মঞ্চে উঠার জন্য মাটি বা ইটের দুই থেকে তিনটি সিঁড়ির ধাপ নির্মিত হয়। মঞ্চের উত্তর বা দক্ষিণ দিকে পরিবেশনার মঙ্গল কামনার্থে একটি চামর ঝুলিয়ে রাখা হয়। চামরের ঠিক বিপরীত দিকে মঞ্চের নিচে সারিবদ্ধভাবে বাদ্যযন্ত্র ও দোহারদের অবস্থান ঠিক করা হয়। বিষহরা গানের পরিবেশনা বাড়ির আঙিনায় হয়ে থাকলে বাদকদল মাঝখানে অবস্থান করেন এবং তাদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে চরিত্র অনুযায়ী শিল্পীগণ নৃত্য সহযোগে অভিনয় করেন।
আলোকসজ্জা: কান্দনী বিষহরির গানে বর্তমানে বিদ্যুতের ব্যবহার ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যায়। তবে পূর্বে হ্যারিকেন ও হ্যাজাক বাতির প্রচলন ছিল।
সাজগৃহ: সাজসজ্জার জন্য মঞ্চের খানিকটা দূরে কাপড়ে ঘেরা অস্থায়ী ব্যবস্থা থাকে। এছাড়া, অনেক সময় সাজসজ্জার জন্য একজন দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
পোশাক ও অলংকারের ব্যবহার: কান্দনী বিষহরির গানে প্রধান চরিত্রসমূহের জন্য বিশেষ পোশাক থাকলেও অন্যান্য কিছু মুখ্য চরিত্রের পোশাক সাধারণ পোশাকের আদলেই হয়ে থাকে।
অভিনয় উপকরণ: কান্দনী বিষহরির গানে বেশ কিছ অভিনয় উপকরণ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন- চামর, তীর-ধনুক, তরবারি, লাঠি, বড়শি, গামছা, রুমাল, সাপের প্রতীক, শাড়ি, প্রদীপ ডালা, ত্রিশূল, ধূপদানী, শাখা-সিঁদুর, মালা প্রভৃতি সামগ্রী ব্যবহৃত হয়।
বাদ্যযন্ত্র: কান্দনী বিষহরির গানে হারমোনিয়াম, কোনও কোনও ক্ষেত্রে ক্যাসিও, খোল, করতাল, জুরি, জিপসীর ব্যবহার বেশ লক্ষণীয়।
আসর পরিচালনা: কান্দনী বিষহরির গান পরিচালনার দায়িত্বে ম্যানেজার নিযুক্ত থাকেন। সাধারণত গিদাল ও তার সহযোগীগণ এ দায়িত্ব পালন করলেও কখনো কখনো অন্যান্য মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেতা আসর পরিচালনা করে থাকেন।
পরিবেশনা রীতি: কান্দনী বিষহরির গানে মূল পরিবেশনা শুরুর আগে কুশীলবগণ মন্দিরে মনসা দেবীকে ভক্তি জানিয়ে এসে একে একে চাঁদ সওদাগর, লক্ষীন্দর, বেহুলা মঞ্চে বন্দনা করেন। এ ধরনের অভিনয়ে বিভিন্ন চরিত্রে সংলাপাত্মক অভিনয়ের পাশাপাশি বর্ণনাত্মক অভিনয়ের রীতি প্রচলিত।
শিল্পীদের বর্তমান অবস্থা: কান্দনী বিষহরির গান বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা ছাড়াও পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও জেলার বিভিন্ন গ্রামে পরিবেশিত হয়ে থাকে। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে কান্দনী বিষহরির গান পরিবেশনে এখন যেন অনেকটা ভাটা পড়েছে। পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজোর শান্তির হাট নামক স্থানে একটি প্রসিদ্ধ কান্দনী বিষহরি গানের দলের সন্ধান পাওয়া যায়।
রবিউল হক, লোক গবেষক ও শিল্পী
তথ্যসূত্র :
১. সাইমন জাকারিয়া, বাংলাদেশের লোকনাটক: বিষয় ও আঙ্গিক বৈচিত্র্য, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০৮, পৃ.১৯৮
আই.কে.জে/