ছবি: সংগৃহীত
‘মাহবুব ক্রিয়েশন ফোর’ নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে প্রথম ছিন্নমূল মানুষদের চুল ও জটা কাটার উদ্যোগ নেওয়া হয়। পথে পথে ছিন্নমূল মানুষদের পরিষ্কার করার নামে তাদের চুল কেটে দেওয়া হতো। শুধু ছিন্নমূল নয়, ফকির-সন্ন্যাসী কেউই এর বাইরে থাকতেন না। পুরো দৃশ্য ভিডিও করে ফেসবুকে প্রকাশ করা হতো। এগুলোর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল—ফেসবুক থেকে আয়ের জন্য এসব ভিডিও বানানো। পাশাপাশি প্রবাসীদের কাছ থেকেও অনুদান নেওয়া হতো।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, একজন মানুষকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার নামে যে ব্যয় হয়, ভিডিও থেকে তার বহুগুণ আয় করা সম্ভব হয়। এর সঙ্গে যোগ হয় দেশি ও প্রবাসীদের অনুদান। চুল ও জটা কেটে দেওয়ার আড়ালে গড়ে ওঠে বড় এক বাণিজ্য। অথচ যারা অর্থ সহায়তা দেন, তারা এই নেপথ্যের হিসাব জানেন না।
মাহবুব ক্রিয়েশন ফোরের এসব কাজ মাঝেমধ্যেই সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হতো। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে একটি ভিডিও—যেখানে এক ব্যক্তির জোর করে জটা কেটে দেওয়া হয় এবং তার হাতের বালা খুলে নেওয়া হয়। কারণ, ওই ঘটনায় ধস্তাধস্তি ও মারামারিও হয়। জানা যায়, ওই ব্যক্তির নাম লিটন সাধু। তিনি রাজধানীর পোস্তগোলা মহাশ্মশানে লাশ সৎকারের কাজ করেন এবং পাশাপাশি সদরঘাট এলাকায় ফল বিক্রি করেন। আধ্যাত্মিক ভাবনা থেকে তিনি দীর্ঘদিন চুল-দাড়ি লম্বা রেখেছিলেন। দুই হাতে ছিল ধাতব বালা।
মাহবুব ক্রিয়েশন ফোরের উদ্যোক্তা মাহবুবুর রহমান ও তার দল লিটন সাধুর জটা ও চুল-দাড়ি জোরপূর্বক কেটে দেন। এ সময় লিটন সাধু প্রাণপণ চেষ্টা করেও নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি। তিনি লাথিও মেরেছিলেন, কিন্তু সব ব্যর্থ হয়। চুল কেটে দেওয়ার পর তার হাতের প্রায় ৫০ ভরি রুপার বালা লুটে নেওয়া হয়, যার মূল্য আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা।
লিটন সাধুকে যেভাবে ধরে চুল ও জটা কেটে দেওয়া হয়েছে, একইভাবে আরো অনেককেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার নামে এভাবে চুল ও জটা কেটে দেওয়া হয়েছে। মাহবুবের এমন কর্মকাণ্ডের খবর প্রথম প্রকাশিত হয় গত ১৪ই আগস্ট সুখবর ডটকম অনলাইনে। এরপর দেশের অন্যান্য গণমাধ্যমও বিষয়টি প্রকাশ করে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে। মাহবুবই দেশে এ ধরনের চুল ও জটা কাটার প্রবণতা প্রথম শুরু করেন— সম্প্রতি তার ফেসবুক লাইভের বক্তব্য থেকেও সেটি স্পষ্ট হয়।
তবে সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে আরেকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যেখানে দেখা যায়, দুজন মিলে বয়স্ক এক ব্যক্তিকে জোরপূর্বক চুল দাঁড়ি কেটে দিচ্ছেন, একপর্যায়ে বৃদ্ধ লোকটি হাল ছেড়ে দিয়ে বলছেন 'আল্লাহ তুই দেহিস'। ঘটনাটি ঘটে প্রায় তিন মাস আগে ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার কাশিগঞ্জ বাজারে। যে বৃদ্ধের চুলদাঁড়ি কেটে দেওয়া হয়, তার নাম হালিম উদ্দিন আকন্দ।
ভিডিওর বিভিন্ন খুঁটিনাটি দেখে বিবিসি বাংলা অনুসন্ধান করে, কারা হালিম উদ্দিন আকন্দের চুল কাটার ঘটনার সঙ্গে জড়িত এবং কেন তারা এই কাজ করলেন। বিবিসি জানায়, ফেসবুক-ভিত্তিক 'হিউম্যান সার্ভিস বাংলাদেশ' নামে একটি সংগঠনের লোকেরা হালিম উদ্দিন আকন্দের চুলদাড়ি কেটে দেন। 'হিউম্যানিটি ফার্স্ট বিডি' নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলও আছে তাদের।
যেখানে বিভিন্ন সময় জোর করে রাস্তাঘাটে অসুস্থ ও অপ্রকৃতিস্থ লোকজনের চুল দাঁড়ি কেটে, তাদের গোসল করিয়ে পরিষ্কার জামা-কাপড় পরানো হচ্ছে এমন ভিডিও আছে। সংগঠনটি ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে পরিচালিত হয় এবং ২০২৪ সালের শেষের দিকে তারা কার্যক্রম শুরু করে। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন মুফতি সোহরাব হোসেন আশরাফি।
তিনি বিবিসি বাংলাকে জানান, মূলত মানবিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিভিন্ন জেলায় গিয়ে অসুস্থ ও অপ্রকৃতিস্থ লোকজনকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করেন। এটাকে তারা সেবা হিসেবেই দেখেন। কিন্তু জোর করে এই কাজ করার উচিত কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে সোহরাব বলেন, 'তারা জোরপূর্বক কারও চুলদাড়ি কাটেন না।' তবে তাদের অনেক ভিডিওতে জোর জবরদস্তি করে লোকজনের চুলদাড়ি কাটা ও গোসল করাতে দেখা গেছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলেছে, জোরপূর্বক চুল কেটে দেওয়া একটি গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ এবং এটি সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সংবিধানের ৩১, ৩২ ও ৩৫ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রতিটি নাগরিককে আইনের আশ্রয়, ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণ থেকে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার দিয়েছে। কিন্তু এই সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতির সঙ্গে মাঠের বাস্তবতার মধ্যে ফারাক আকাশ-পাতাল। জোরপূর্বক চুল কাটার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবিও জানায় মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
এদিকে, আলোচিত-সমালোচিত কথিত উদ্যোক্তা মাহবুবুর রহমান নিজের নামে একটি ওয়েবসাইট খুলেছেন। সেখানে ‘জীবনবৃত্তান্ত’ আকারে নিজের পরিচয় দিয়েছেন তিনি। সফল কনটেন্ট ক্রিয়েটর দাবি করে লিখেছেন, তার নাম মাহবুবুর রহমান, ডাক নাম মাহবুব সরকার। বাবার নাম সামছুল আলম। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার বাইশগাঁও গ্রামে। স্থানীয় পঞ্চগ্রাম স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক পাস করে ২০২০ সালে উচ্চমাধ্যমিক পড়ার জন্য ঢাকা উদ্যান সরকারি কলেজে ভর্তি হন তিনি।
ওয়েবসাইটে মাহবুব লিখেছেন, 'ঢাকা আসার পর থেকে রাস্তার এই মানুষগুলোকে দেখে ভেতরে একটা মায়া কাজ করত। তাদের কাছাকাছি যেতাম। তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করতাম। ২০২১ সালে আমার ভেতরে এই মানুষগুলোকে নিয়ে ভাবনা শুরু হয়। তাদের জন্য কিছু একটা করার আগ্রহ বাড়তে থাকে।' তার দলের সদস্য হিসেবে তিনি মাহফুজ, সৌরভ দাশ ও প্রিতম শর্মার নাম উল্লেখ করেছেন।
সম্প্রতি ফেসবুক লাইভে মাহবুব বলেন, 'সম্প্রতি আমাদের কাজগুলোকে অনেকেই সমালোচনা করছেন, ট্রল করছেন। আমরা অত্যন্ত কষ্টের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, আমরা হয়তো কাজটা আর বেশি দিন করতে পারব না, আমরা হতাশ হয়ে যাচ্ছি। এতো বাজেভাবে আমাদের কাজ উপস্থাপন করছে যা বলার বাইরে।'
অর্থাৎ মাহবুবের কাজ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে। তাকে অনুসরণ করে অনেকে উৎসাহী হয়ে ওঠে, কারণ এই কাজে খরচ কম অথচ ফেসবুক–ইউটিউবের রাজস্ব ও অনুদানের সুযোগ বেশি। মাহবুব নিজেই অনেকের চুল জোরপূর্বক কেটে দিয়েছেন, যার ভিডিও তার ইউটিউব ও ফেসবুক পেজে রয়েছে।
নিজের কাজ শুরুর গল্প বলতে গিয়ে তিনি বলেন, 'আমি যখন ২০২০ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ঢাকায় আসি, তখন এদের এই অবস্থা দেখে আমার খুবই খারাপ লাগে, তখন এসব কাজ শুরু করি। তবে খাওয়ার দাওয়ার দেওয়া, পরিচ্ছন্ন করার এই কাজ আমরা শুরু করি দুই বছর হয়ে গেছে। এই দুই বছরে আমরা কোনো প্রশ্নের মুখে পড়িনি।'
নিজের টিম একটাই উল্লেখ করে এই তরুণ বলেন, ‘আমার একটাই টিম, আমার কোনো জেলাতে টিম নেই। আমরা যখন কাজ করি মানুষগুলোর সঙ্গে খুবই নমনীয় ব্যবহার ও ভালোবাসা দেখিয়ে কাজ শুরু করি। কখনো তাদেরকে কষ্ট দেওয়া হয় না কিংবা আঘাত দেওয়া হয় না। ইদানীং দেখছি অনেকেই এসব কাজ করছেন, যারা বলছেন এসব আমাদের টিম বা আমাদের হয়ে কাজ করছেন। এসব টিমগুলোর কারণে আমি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছি।’ তবে অনুসন্ধান বলছে, বাস্তবে মাহবুব দীর্ঘদিন মানবাধিকার লঙ্ঘন করে এসব কাজ চালিয়ে গেছেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া এ প্রসঙ্গে বলেন, 'তারা চুল কেটে দিচ্ছেন, তাদের একটা নিজস্ব বিশ্বাসের জায়গা থেকে, যেটা তাদের এখতিয়ারে নেই। ওই ব্যক্তির কোনো দায়িত্ব নেবেন না, পুনর্বাসন করবেন না। যদি ধরে নিই, ব্যক্তির চালচলনের জায়গা থেকে তাকে পুনর্বাসন করবেন, তাহলে সেটারও না হয় একটা অর্থ দাঁড়ায়। কিন্তু কেবল সাধক, ফকির বা সন্ন্যাসীদের চুল কেটে দেওয়ার আদর্শিক জায়গা থেকে কারও এখতিয়ার নেই। সংবিধান কাউকেই অন্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার এখতিয়ার দেয়নি।'
এ ধরনের কাজকে ‘ক্রিমিনাল অফেন্স’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'আমি চুল লম্বা রাখব না ছোট রাখব, না আদৌ রাখব না, সেটা তো আমার সিদ্ধান্ত। এখানে রাষ্ট্রেরও হাত দেওয়ার সুযোগ নেই।' সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, 'কেউ যদি আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার হাত ভেঙে দেন, এটা তার অপরাধ হবে না? চুলও আমার শরীরের অংশ। এটার জন্য ফৌজদারি মামলা হয়ে শাস্তি হতে পারে।'
তবে এতোদিনে এসে মাহবুব আইন বুঝেছেন। যে ফেসবুক পেজ থেকে এসব কর্মকাণ্ডের ভিডিও প্রকাশ করতেন, সেখানেই নিজের কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণা জানিয়ে বললেন, ‘মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষদের নিয়ে আমাদের যে কার্যক্রম পরিচালনা করতাম, সেটা সম্পূর্ণ বন্ধ ঘোষণা করলাম। কাজটা আমাদের চোখে ভালো মনে হলেও আইনের দিক থেকে এটা বেআইনি। তাই দেশের আইনের প্রতি সম্মান জানিয়ে কাজটা ছেড়ে দিলাম।’
আরেক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘যদি আমাদের কাজটা অপরাধ হয়ে থাকে, তাহলে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। হয়তো আমার চোখে যেটা ভালো সেটা আপনাদের চোখে খারাপও হতে পারে। তাই যদি ভুল করে থাকি। ছোট মানুষ হিসেবে ক্ষমা করে দেবেন। আজ থেকে আমাদের সব কার্যক্রম বন্ধ থাকবে সবাই ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ।’
খবরটি শেয়ার করুন