ছবি - সংগৃহীত
‘জয় বাংলা’ শব্দটি কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাঙার গান কাব্যগ্রন্থের ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ (১৯২২) কবিতার অংশ। তিনি লিখেছিলেন,‘জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি অন্তরীণ, জয় যুগে যুগে আসা সেনাপতি, জয় প্রাণ আদি-অন্তহীন।’
কবিতার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানা যায়, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা ছিলেন মাদারীপুরের স্কুল শিক্ষক পূর্ণ চন্দ্র দাস। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের জন্য জেল-জুলুম-নির্যাতনের শিকার হন। তার আত্মত্যাগ, দেশপ্রেমে মুগ্ধ হয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ কবিতাটি রচনা করেন। পরবর্তীতে কবিতাটি ভাঙার গান কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়। পরবর্তীতে তাঁর রচিত ‘বাঙালির বাঙলা’ প্রবন্ধেও জয় বাংলা পাওয়া যায়। যা নবযুগ পত্রিকায় ৩রা বৈশাখ, ১৩৪৯ বঙ্গাব্দ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। তিনি লিখেছেন-
বাঙালিকে, বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এই এক মন্ত্র শেখাও;
এই পবিত্র বাংলাদেশ
বাঙালির-আমাদের।
দিয়া ‘প্রহারেণ ধনঞ্জয়’
তাড়াব আমরা করি না ভয়
যত পরদেশী দস্যু ডাকাত
রামাদের গামা’দের
বাঙলা বাঙালির হোক। বাঙালির জয় হোক। বাঙালির জয় হোক।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে আস্তে আস্তে ‘জয় বাংলা’ শব্দটি একটি স্লোগানে পরিণত হয়। ১৯৬৯ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে শিক্ষা দিবস (১৭ই মার্চ) যৌথভাবে পালনের জন্য কর্মসূচি প্রণয়নের সর্ব দলীয় সংগ্রাম পরিষদের সভায় তৎকালীন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আফতাব আহমাদ ও চিশতী হেলালুর রহমান "জয় বাংলা" স্লোগানটি সর্বপ্রথম উচ্চারণ করেন। তবে ১৯৭০ সালের ১৯শে জানুয়ারি পল্টন ময়দানের এক জনসভায় ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান তার ভাষণে সর্বপ্রথম "জয় বাংলা" স্লোগানটি উচ্চারণ করেছিলেন। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে প্রথম "জয় বাংলা" স্লোগানটি উচ্চারণ করেন। সেখানে তিনি ‘জয় বাংলা’ শব্দটি বলে ভাষণটি সমাপ্ত করেন। এই ভাষণের পর থেকে এটি সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করে। ১৯৭১-এর মার্চ থেকে জনসভা, মিছিলে এবং প্রচারণায় ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি ব্যবহৃত হতে থাকে।
১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান কালুর ঘাট অস্থায়ী বেতার কেন্দ্র থেকে যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন তার শেষেও তিনি "জয় বাংলা" উচ্চারণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সব সময় ‘জয় বাংলা’ ব্যবহার করা হতো। এই বেতার কেন্দ্রের স্বাক্ষরসঙ্গীত ছিল জয় বাংলা, বাংলার জয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ১১ই এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে প্রচারিত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহ্মদের প্রথম বেতার ভাষণটি শেষ হয়েছিল ‘জয় বাংলা, জয় স্বাধীন বাংলাদেশ’ স্লোগান দিয়ে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা জয় বাংলা স্লোগানে অনুপ্রাণিত হয়ে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। তারপর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে জয় বাংলা রাজনৈতিক স্লোগান হিসাবে ব্যবহার হয়৷ আওয়ামী লীগ তাদের রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করে। এর পাল্টা অন্যান্য দলগুলো ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ শব্দটি ব্যবহার করতে শুরু করে। এভাবেই যুগের পর যুগ চলে এসেছে। অথচ জয় বাংলা শব্দটি আওয়ামী লীগের নিজস্ব কোনো স্লোগান নয়।
২০২০ সালের ১০ই মার্চ জয় বাংলা স্লোগানকে বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হিসেবে গ্রহণের জন্য হাইকোর্ট রায় প্রদান করেন। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, ‘জয় বাংলা কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণার পর জাতীয় দিবসগুলোতে উপযুক্ত ক্ষেত্রে সাংবিধানিক পদাধিকারী ও রাষ্ট্রীয় সকল কর্মকর্তা সরকারি অনুষ্ঠানে বক্তব্য শেষে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ এবং সারাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাত্যহিক সমাবেশ শেষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীগণকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ করতে হবে। তারপর থেকে এভাবেই চলে এসেছিল। কিন্তু গত ১০ই ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এই স্লোগানটি এখন থেকে আর জাতীয় স্লোগান নয় বলে রায় দেন এবং পূর্বের হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেন।
‘জয় বাংলা’ নিয়ে চরম দ্বন্দ্ব ও বিভক্তি দেখা দিয়েছে, যা মোটেও কাম্য নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও সশস্ত্র যুদ্ধে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান এক অনন্য ভূমিকা পালন করে। এই স্লোগান মুক্তিযুদ্ধে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন বাঙালির প্রেরণার উৎস। সিরাজুল আলম খান তার বইতে লিখেছেন- ‘জয় বাংলা’ কোনো দল বা ব্যক্তির স্লোগান নয়। এই স্লোগান ছিল বাঙালির আত্মপরিচয়ের স্লোগান। যে স্লোগান বাঙালি জাতিকে করেছিল ঐক্যবদ্ধ। এটা নিছক কোনো স্লোগান নয়। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস।
আই.কে.জে/