রাজধানীসহ সারাদেশে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে পাড়া-মহল্লার অলিগলি, ফ্ল্যাট বাড়ি বা ছাদে ‘ব্যাঙের ছাতার মতো’ যত্রতত্র গড়ে ওঠেছে বেসরকারি প্রাক-প্রাথমিক ও কিন্ডারগার্টেন (কেজি) স্কুল। এর মধ্যে প্রায় ৪০০ কিন্ডারগার্টেন স্কুল শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন পেলেও বাকি লক্ষাধিক প্রতিষ্ঠান অনুমোদনহীন। তবুও চলছে সেগুলোর ‘কার্যক্রম’।
সারাদেশেই, বিশেষ করে শহরাঞ্চল ও মহানগরগুলোতে চাহিদার তুলনায় মানসম্মত সরকারি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতার কারণে বেসরকারি পর্যায়ে যত্রতত্র কিন্ডারগার্টেন স্কুল চালু হয়েছে। বাসস্থানের নিকটবর্তী হওয়ায় শিশুদের যাতায়াতের সুবিধা এবং নিরাপত্তার বিষয় চিন্তা করে অনেক অভিভাবক অনিচ্ছা সত্ত্বেও সন্তানকে এসব কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি করান।
কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার বিষয়ে সরকারি কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা না থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এবং ব্যক্তিবিশেষের মর্জিমাফিকে এসব স্কুল পরিচালিত হতে দেখা যায়।
ধারণা করা হচ্ছে, প্রায় ২ কোটি শিশু এসব প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করছে। অনভিজ্ঞ শিক্ষক, সঠিক সিলেবাসের অভাব এবং উপযুক্ত গাইডলাইন না থাকায় সেগুলোতে মানসম্মত শিক্ষার বড় অভাব। অথচ ইচ্ছেমতো ভর্তি ও টিউশন ফি ছাড়াও বিভিন্ন পরীক্ষার নামে গলাকাটা চার্জ আদায় করছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছোট পরিসরে শুরু করলেও এখন ‘স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ নাম দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের ‘কার্যক্রম’। পাবলিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের নিবন্ধনে এসব কিন্ডারগার্টেনের অনুমোদন না থাকলেও অন্য স্কুলের নামে তারা নিবন্ধন করিয়ে শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষায় বসাচ্ছে। বাংলা মাধ্যমের পাশাপাশি এসব কিন্ডারগার্টেনের কোনো কোনোটি ইংরেজি মাধ্যমও চালু করেছে।
সেখানে প্লে-গ্রুপ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হচ্ছে। অথচ অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানেরই সর্বোচ্চ পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর কথা। অনুমোদনহীন হয়েই পড়াচ্ছে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। এসব প্রতিষ্ঠানে অস্বাস্থ্যকর ও সংকীর্ণ পরিবেশে ক্লাস-পরীক্ষা চলছে। একটি কক্ষ বা একটি খুপরি ঘরই যেন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
অনেক প্রতিষ্ঠানে শ্রেণিকক্ষেই শরীরচর্চা, জাতীয় সংগীত এবং শপথ পাঠ করানো হয়। অনেক প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষ প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন। দিনের বেলায় বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয়। নেই পর্যাপ্ত শিক্ষকও। যারা এসব কিন্ডারগার্টেনে পাঠদান করাচ্ছেন, তাদের অধিকাংশই আবার কলেজপড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী। পার্টটাইম ক্লাস-পরীক্ষা নিচ্ছেন তারা। তাদেরও নেই প্রাতিষ্ঠানিক কোনো প্রশিক্ষণ।
ভুঁইফোঁড় এসব স্কুলে ভর্তি হয়ে কোমলমতি শিশুরা শিক্ষাজীবনের শুরুতেই যথাযথ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে উচ্চস্তরে গিয়ে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। নার্সারি ও কেজির শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি ও গণিতের পাশাপাশি প্রায় এক ডজন বই পড়তে হচ্ছে। অথচ কোনোটাই সঠিকভাবে পড়ানো হয় না। শুধু মুখস্থ পড়িয়ে দায় শেষ করা হয়।
অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেন স্কুলে প্লে-গ্রুপে জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কোনো বই না থাকলেও তাদের পছন্দ মতো একগাদা বই কিনতে বাধ্য করা হয়। এভাবে প্লে থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসে এনসিটিবির পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অতিরিক্ত বই পড়ানো হচ্ছে। বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া কিন্ডারগার্টেনের এসব শিক্ষার্থীর একদিকে যেমন মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে অতিরিক্ত বইয়ের চাপে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে ভবিষ্যৎ।
কিন্ডারগার্টেন শিক্ষাব্যবস্থায় প্রথম শ্রেণিতে পড়ার আগেই একটি শিশুকে প্লে, নার্সারি ও কেজি—এ তিনটি শ্রেণিতে মোট তিন বছর কাটাতে হয়। প্রতিবছরই প্রতিটি শিক্ষার্থীকে মোটা অঙ্কের ভর্তি ফিসহ নানা ধরনের চার্জ পরিশোধ করে নতুনভাবে ভর্তি হতে হয়। অনেক স্কুলে কোনো কোনো বই দেওয়া হয়, যা শুধু অপ্রয়োজনীয় নয়, বরং শিশুদের শ্রেণি ও বয়স বিবেচনায় মোটেও মানানসই হয় না।
জানা গেছে, দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৬৫ হাজারের বেশি। অন্যগুলো কিন্ডারগার্টেনসহ বেসরকারি বিদ্যালয়। বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশের নিবন্ধন নেই। ইচ্ছেমতো তারা চলছে। বিধিমালা থাকলেও বাস্তবে অনেকে মানছেন না।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী, ভাড়া, বা স্থায়ী ভবনে হোক, মহানগর এলাকায় ন্যূনতম ৮ শতক, পৌরসভায় ১২ শতক এবং অন্য এলাকায় ৩০ শতক জমিতে কিন্ডারগার্টেন স্কুল হতে হবে।
এ ছাড়া শিক্ষকদের আলাদা কক্ষ, পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, গ্রন্থাগার ও সুপেয় পানির সুব্যবস্থাসহ ছেলেমেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু অধিকাংশ স্কুল এসব নিয়ম না মেনেই গড়ে ওঠেছে।
কিন্ডারগার্টেনের নামে লাগামহীন ‘শিক্ষাবাণিজ্য’ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। মানহীন শিক্ষা ও পরিবেশের অভাব শিশুদের শিক্ষা-জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আমরা মনে করি, সরকারকে শিক্ষা নীতিমালা বাস্তবায়নে কঠোর হতে হবে এবং বাড়াতে হবে নজরদারি।
এইচ.এস/
খবরটি শেয়ার করুন