ছবি: সংগৃহীত
নিউইয়র্ক নগরের মেয়র পদে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাইমারিতে (দলীয় বাছাই) নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোকে হারিয়ে জয়ী হলেন দক্ষিণ এশীয় অভিবাসী সন্তান, বয়সে তরুণ জোহরান মামদানি। তারপর ৪ঠা নভেম্বর মেয়র নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর শুধু নিউইয়র্ক নয়, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে নতুন এক চমক তৈরি করলেন তিনি। তখন সবার দৃষ্টি ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার জনপ্রিয় প্রচার আর তার প্রতি তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করার কৌশলের দিকে।
তবে জোহরানের এই ঐতিহাসিক বিজয়ের নেপথ্যে ছিলেন এক কৌশলী চিন্তাশীল মানুষ। তিনিও অভিবাসী পরিবারের সন্তান, বয়সে তরুণ, তবে জন্ম যুক্তরাষ্ট্রেই। তার নাম জারা রহিম। বাংলাদেশি অভিবাসী পরিবারে তার জন্ম। এক দশকের বেশি সময় ধরে তিনি রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে ডিজিটাল কৌশলকে দারুণভাবে ব্যবহার করে কাজ করে চলেছেন। তথ্যসূত্র: ফরচুন।
জারা রহিম গত ফেব্রুয়ারি থেকে জোহরানের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। তিনি এমন এক পরামর্শ দেন, যা জোহরানের পুরো নির্বাচনী প্রচারের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল।
নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নবনির্বাচিত মেয়রের এক উপদেষ্টা বলেছিলেন, জোহরান মামদানিকে জারা রহিম পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘রাজনৈতিক কৌশলবিদদের বানানো কল্পিত নিউইয়র্ককে ভুলে যাও, প্রকৃত নিউইয়র্ক নগর নিয়ে প্রচার চালাও।’
জারার এই ধারণাই তৈরি করে দেয় এক তৃণমূল আন্দোলন, যেখানে ৯০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক কাজ করেছেন। তাদের মাধ্যমে সেসব ভোটারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা হয়, যাদের নিউইয়র্ক নগরের রাজনীতি এত দিন উপেক্ষা করে এসেছে।
জারা রহিম বাংলাদেশি অভিবাসী মা–বাবার সন্তান। বড় হয়েছেন সাউথ ফ্লোরিডায়। তারা বসবাস করতেন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বহুসাংস্কৃতিক এলাকাগুলোর একটিতে।
সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইউসিএফ) জারা যোগাযোগবিদ্যা (কমিউনিকেশনস) নিয়ে পড়াশোনা করেন। মানুষের গল্প কীভাবে মন ছুঁয়ে যায়, জনমত গঠন করে আর সমাজ তৈরি করে, সেই বিষয় তিনি সেখানে ভালো রপ্ত করেছেন। এ সময়েই জারা বুঝতে পারেন, প্রযুক্তি কীভাবে গল্প বলার ধরন বদলে দিতে পারে।
জারার কলেজের বন্ধুরা এখনো তাকে মনে করে, তিনি একজন চিন্তাশীল মানুষ, তবে উদ্যমী। তিনি এমন একজন মানুষ, যিনি রাজনীতি আর পপ–সংস্কৃতি নিয়ে একই নিঃশ্বাসে কথা বলতে পারতেন।
রাজনীতির প্রতি আগ্রহ আর সংস্কৃতির প্রতি বোঝাপড়ার এই মিশ্রণটাই পরবর্তী সময়ে জারার কাজের মূল বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। ৩৫ বছর বয়সী এই যোগাযোগ কৌশলবিদের জীবনের গল্পটা অনেকটা সিনেমার মতো। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন জারা রহিম রাজনীতিতে প্রথম পা রাখেন ২০১২ সালে বারাক ওবামার দ্বিতীয় মেয়াদের নির্বাচনী প্রচারে।
সেখানে নির্বাচনী দলে তিনি শিক্ষানবিশ (ইন্টার্ন) হিসেবে যোগ দেন। পরে তিনি ফ্লোরিডা ডিজিটাল কনটেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে উন্নীত হন। সেখানে তিনি শিখেছিলেন কীভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে ভোটারদের সচেতন ও সংগঠিত করা যায়।
ওবামা প্রশাসনের হোয়াইট হাউস অফিস অব ডিজিটাল স্ট্র্যাটেজিতে কাজ করার পর জারা যোগ দেন উবারে। সেখানে তিনি রাইড শেয়ারিং–সম্পর্কিত আইন প্রণয়নে সহায়তা করেন।
২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারে কাজ করার পর জারা কিছুটা ভিন্ন পথে যান। যোগ দেন ‘ভোগ’ সাময়িকীর যোগাযোগ পরিচালক হিসেবে (২০১৭–১৮ সাল। সেখানে তিনি ফ্যাশন, রাজনীতি, শিল্প আর বিনোদন দুনিয়ার প্রভাবশালী মানুষের সঙ্গে কাজ করে জনসংযোগ ও ভাবমূর্তি তৈরির কৌশল আরও শাণিত করেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জারা যোগাযোগ পরামর্শক হিসেবে এ২৪, মারায়া কেরি এবং নেটফ্লিক্সের মতো মক্কেলদের সঙ্গে কাজ করেছেন। জারার নির্বাচনী প্রচারকৌশলের মূল ছিল নির্ভেজাল ও সরাসরি সংযোগ। বিশেষ করে সেসব জনগোষ্ঠীর সঙ্গে, প্রথাগত রাজনীতি যাদের সাধারণত উপেক্ষা করে। তিনি বুঝেছিলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জনপ্রিয়তা আসল প্রভাব ফেলবে কেবল তখনই, যখন মাটিতে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হবে।
নিউইয়র্ক টাইমসকে জারা বলেন, প্রচারের সময় ছিল ‘কঠোর সময়সূচি’। টিকটক ও ইনস্টাগ্রামের ভিডিও শুটের ফাঁকে জোহরান মামদানি নানা ভাষায় (যেমন স্প্যানিশ ও হিন্দি) কথা বলতেন শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে। বাংলাদেশি চাচারা আর পশ্চিম আফ্রিকার চাচিরা দেখলেন, কেউ তাদের মসজিদে আসছেন, তাদের পাড়াকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। এসব মানুষ জীবনে কখনো মেয়র পদে দলীয় প্রাইমারিতে ভোট দেননি।
খবরটি শেয়ার করুন