ছবি: সংগৃহীত
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নানা অনিশ্চয়তা কাটিয়ে গত ৪ঠা এপ্রিল ব্যাংককে প্রথমবারের মতো দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। দুই দেশের দুই শীর্ষ নেতার বৈঠক ঘিরে সেদিন থেকেই বাংলাদেশ ও ভারতের গণমাধ্যমে নানা আঙ্গিকে সংবাদ প্রকাশিত-প্রচারিত হচ্ছে। বিশ্লেষকদের অভিযোগ ছিল, দুই দেশের সরকারি কর্তৃপক্ষ অন্যপক্ষের পছন্দের নয়, বৈঠকের এমন দু’য়েকটি প্রসঙ্গের অবতারণা করছে শুধু।
বিবিসি বাংলা লিখেছে, ‘সংবাদমাধ্যমের কাছে নিজ নিজ ভাষ্যকে অগ্রাধিকার দিয়েই বৈঠক সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছে ঢাকা ও দিল্লি।’ এর মধ্যেই ভারতীয় কয়েকটি গণমাধ্যমের অভিযোগ, ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে মোদির সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠকে হওয়া আলোচনার বিষয় নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের বক্তব্য ‘ক্ষতিকর ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’। তিনি ‘মিথ্যা’ বলছেন।
আনন্দবাজার পত্রিকা ‘ঢাকার দুর্বুদ্ধি, সরব নয়াদিল্লি’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলছে, প্রেস সচিব শফিকুল আলমের ‘ক্ষতিকর’ বক্তব্যের কারণে ইউনূস-মোদির ‘বৈঠকের ২৪ ঘণ্টা পার হতে না হতেই সংঘাতের (ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে) বাতাবরণ তৈরি হয়ে গেল।’ শফিকুল আলমের বক্তব্যে ‘নাখোশ’ ভারত।
দেশটির ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ ও ‘হিন্দুস্তান টাইমস’ কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে তাদের প্রতিবেদনে জানায়, ব্যাংককে মোদির সঙ্গে বৈঠক নিয়ে ‘মনগড়া গল্প’ বলেছেন ইউনূসের সচিব। ‘হিন্দুস্তান টাইমসের’ বাংলা সংস্করণে এ সম্পর্কিত প্রতিবেদনে ভারতীয় আরেক গণমাধ্যম এএনআই’য়ের সূত্রের বরাতের কথা বলা হয়।
অনুসন্ধান বলছে, মোদি-ইউনূসের বৈঠকের বিষয়ে দুই দেশের সংবাদমাধ্যমের ভাষ্য প্রায় দুই রকম। এমনকি বৈঠকের প্রতিবেদন প্রকাশ-প্রচারে দুই দেশের সংবাদমাধ্যমের ছবি বাছাইয়েও ভিন্নতা আছে। এতে বিভ্রান্তির কবলে পড়ছেন পাঠক, দর্শকরা। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় দুই দেশের সংবাদমাধ্যম হাতের মুঠোয় থাকায় তারা দ্বন্দ্বে পড়েছেন। সত্য-মিথ্যা নিয়ে তারা দ্বিধান্বিত। প্রশ্ন উঠেছে, ইউনূস-মোদির বৈঠকের ‘মনগড়া ভাষ্য’ প্রচার করছে ঢাকা ও দিল্লি?
বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই দেশের দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকের সব বিষয়ে কোনো দেশের গণমাধ্যমের পক্ষেই জানা সম্ভব হবে না। এর মধ্যে নানা কারণ নিহিত। ফলে দুই দেশের গণমাধ্যমের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির সংবাদের মধ্যে প্রকৃত সত্য আড়ালে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো ড. ইউনূস-মোদির হাস্যোজ্জ্বল ছবি দিয়ে বৈঠকের প্রতিবেদন করলেও ভারতীয় কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনের ছবিতে শুধু ড. ইউনূস হাসছেন, মোদির মুখে ‘কূটনৈতিক শিষ্টাচারের হাসিও’ নেই। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো এমন ছবি দিয়ে বোঝাতে চাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে ‘দেখা করতে পেরে নোবেলজয়ী প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ‘আনন্দিত’, তবে মোদি ‘অসন্তুষ্ট’।
বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মধ্যে অনেকে ওই বৈঠক নিয়ে আশাবাদী যে, অস্বস্তিকে পাশ কাটিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক, বা অস্বস্তি পুষে রেখেই ‘ওয়ার্কিং রিলেশন’ (কাজের সম্পর্ক) স্থাপন- যাই হোক না কেন, এর পথচলা শুরু হয়েছে ব্যাংককের বৈঠক থেকে।
তবে ভারতীয় বিশ্লেষকদের মধ্যে অনেকের মতামত ঠিক উল্টো। তাদের দাবি, মোদি-ইউনূসের বৈঠকের ফলে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের বরফ গলবে না। বৈঠকের পরও দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সুরাহার ক্ষেত্রে সন্দেহ রয়ে গেছে। গত বছরের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনাকে ব্যাংককের বৈঠকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি ঢাকা যে তুলেছে, সেটা নিয়েও তারা যথারীতি ‘বিস্ময়’ প্রকাশ করেন।
ভারতের ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত গত ৫ই এপ্রিল বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এক্সট্র্যাডিশন ( প্রত্যর্পণ) একটি জটিল প্রক্রিয়া। এর ওপর শেখ হাসিনা ভারতের বন্ধু ও অতিথি হিসেবে সমাদৃত। বাংলাদেশ তাদের অবস্থান থেকে বললেও ভারতের তা মেনে নেওয়ার কথা নয়।’
প্রেস সচিব শফিকুল আলম মোদির সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক নিয়ে ফেসবুকে জানান, দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। এছাড়া শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ ইস্যুতে কথা বলার সময় মোদি নেতিবাচক ছিলেন না।
সেই সঙ্গে প্রেস সচিব মোদিকে কোট করে লেখেন, ‘শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক থাকাকালীন আমরা আপনার প্রতি তার (হাসিনার) অসম্মানজনক আচরণ দেখেছি। কিন্তু আমরা আপনাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়েছি।’
এ প্রসঙ্গে সূত্রের বরাত দিয়ে ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ তাদের প্রতিবেদনে বলে, প্রধানমন্ত্রী মোদি ২০১৪ সাল থেকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অগ্রগতির কথা বলেছেন এবং এটিকে আমাদের (ভারতের) সমাজ ও জনগণের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব হিসেবে বর্ণনা করেছেন। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদি যে কোনো গণতন্ত্রে বৈধতার ভিত্তি হিসেবে নির্বাচনের গুরুত্বের কথাও তুলে ধরেছেন।
তিনি (নরেন্দ্র মোদি) বলেছেন, ‘এ বিষয়ে ক্রমাগত গড়িমসি প্রধান উপদেষ্টার সুনাম নষ্ট করবে। এছাড়াও সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বানোয়াট অভিযোগ বলে বাংলাদেশিদের দাবিকে তথ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উড়িয়ে দেয় ভারত।’
ভারতীয় ওই পত্রিকাকে ‘সূত্র জানিয়েছে যে, বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ অনুরোধের বিষয়ে প্রেস সচিবের মন্তব্যের কোনো ভিত্তি নেই। এ ধরনের প্রচেষ্টা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গুরুত্ব ও বিশ্বাস উভয়কেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।’ এ বিষয়ে প্রেস সচিবের কোনো ব্যাখা পাওয়া যায়নি।
ইউনূস-মোদির ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে দ্বিপক্ষীয় বৈঠককেও ভারতীয় কয়েকটি সংবাদমাধ্যম হেয়ভাবে প্রচার করে। আবার এ দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো বৈঠকের কথা তুলে ধরে একতরফা প্রশংসার মাধ্যমে।
‘হিন্দুস্তান টাইমস বাংলা’ বৈঠকের শিরোনাম করে ‘মিষ্টি ভাষায় কড়া বার্তা ইউনূসকে, বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টাকে কী বললেন মোদী?’ ‘সংবাদ প্রতিদিন’ শিরোনাম করে, ‘বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন থেকে চৈনিক চাল, সম্পর্কে শৈত্যের মাঝেই বৈঠকে মোদি-ইউনূস’।
‘এনডিটিভি’ শিরোনাম করে, ‘যে কোনো উসকানিমূলক বক্তব্য... উত্তর-পূর্ব মন্তব্যের পর বাংলাদেশের নেতার উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর বার্তা’। ‘হিন্দুস্তান টাইমস ইংরেজি’ সংস্করণের শিরোনাম ছিল, ‘ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশে হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি’।
পশ্চিমবঙ্গের ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র শিরোনাম ছিল- ‘পরিবেশ কলুষিত করতে পারে এমন কথা নয়, ব্যাঙ্ককে ইউনূসকে বার্তা মোদির’। প্রতিবেদনটিতে শুধু ড. ইউনূস হাসছেন, মোদির মুখে ‘হাসি’ নেই। পত্রিকাটি বোঝাতে চাচ্ছে, মোদির সঙ্গে ‘দেখা করতে পেরে’ ড. ইউনূস ‘আনন্দিত’!
ভারতীয় গণমাধ্যমের নেতিবাচক প্রচারণার মধ্যেও মুহাম্মদ ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদির বৈঠককে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন দুই দেশের অনেক বিশ্লেষক। তাদের মতে, এ বৈঠকের মাধ্যমে সম্পর্কের আমূল পরিবর্তন হবে না। কোনো একক দলের বদলে রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারত সম্পর্ক রাখলে দুই দেশের জন্যই সেটা সম্মানের হবে।
এইচ.এস/