ফাইল ছবি
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ যখন মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয়ের প্রায় দ্বারপ্রান্তে, তখন সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম দৈনিক ইত্তেফাককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কী বলেছিলেন, এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন গবেষক ও কলামিস্ট মহিউদ্দিন আহমদ।
সাক্ষাৎকারে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আক্রমণাত্মক সমালোচনা করে গোলাম আযম দেশটির বিরুদ্ধে 'অবিলম্বে জিহাদ ঘোষণা করা উচিত' বলে দাবি করেন। তিনি ভারতের বিরুদ্ধে দাঁত ভাঙা জবাব দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে বলেন, তা না করলে ভারত কখনোই উসকানিমূলক তৎপরতা (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দেওয়া) থেকে বিরত হবে না।
যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক সমাধান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির কথা বলেন, তখন গোলাম আযম 'অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে' ওঠার কথা বলেন সাক্ষাৎকারে। তিনি দাবি করেছিলেন, পাকিস্তানের জনগণ তাদের দেশের পবিত্র ভূমির প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষা করতে সম্পূর্ণ তৈরি। জামায়াত নেতার প্রশ্ন ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ইন্দিরা গান্ধীকে কখনো তাদের বিষয়ে ওকালতি করতে বলেনি। তিনি কেন শেখ মুজিবের পক্ষে কথা বলছেন? একইসঙ্গে তিনি দাবি করেছিলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবের আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন।
মহিউদ্দিন আহমদ তথ্যসহ উল্লেখ করেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হিসেবে জামায়াত ভূমিকা রাখলেও ওই সময়েও দলটিকে নিষিদ্ধের দাবি ওঠে সাবেক পশ্চিম পাকিস্তানে। তখন পশ্চিম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাটকীয় পালাবদল চলছিল। পাকিস্তান পিপলস পার্টি জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানায়। দলটি বলে, জামায়াতের আমির আবুল আলা মওদুদী পাকিস্তান সৃষ্টির বিরুদ্ধেও (১৯৪৭ সালে) ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। জামায়াতের প্রচারপত্রেই এর প্রমাণ আছে।
দৈনিক প্রথম আলোতে 'মুক্তিযুদ্ধের সরল গল্পের বাইরের গল্প' শিরোনামে প্রকাশিত এক উপসম্পাদকীয়তে মহিউদ্দিন আহমদ এসব কথা বলেন। তার লেখাটি গতকাল সোমবার (১লা ডিসেম্বর) পত্রিকাটির ছাপা সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান জনসংখ্যা প্রধান কয়েকটি দেশের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করার প্রসঙ্গটিও তথ্যসহ তার লেখায় ওঠে এসেছে। একাত্তরের ১লা ডিসেম্বর ইত্তেফাক–এ পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযমের সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়।
সাক্ষাৎকারের একটি প্যারা নিজের লেখায় উদ্ধৃত করেন মহিউদ্দিন আহমদ। এতে গোলাম আযম বলেন, ‘অবস্থা দেখে মনে হয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে গ্রাস করতে চাচ্ছেন। পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে মিসেস গান্ধীর কী করণীয় থাকতে পারে? পূর্ব পাকিস্তান কি ভারতের অংশ?'
তিনি বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ইন্দিরা গান্ধীকে কখনো তাদের বিষয়ে ওকালতি করতে বলেনি। তিনি কেন শেখ মুজিবের পক্ষে কথা বলছেন? যদি কিছুসংখ্যক আওয়ামী লীগার ভারতের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে থাকেন, তার অর্থ এই নয় যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ইন্দিরাকে তাদের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানিয়েছে। যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক সমাধান এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির কথা বলেন, তখন আমি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠি।'
গোলাম আযম দাবি করেন, 'পাকিস্তানের জনগণ তাদের দেশের পবিত্র ভূমির প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষা করতে সম্পূর্ণ তৈরি। পাকিস্তানের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য ভারতের বিরুদ্ধে অবিলম্বে জিহাদ ঘোষণা করা উচিত। দাঁত ভাঙা জবাব না দেওয়া হলে ভারত কখনোই উসকানিমূলক তৎপরতা থেকে বিরত হবে না।'
মহিউদ্দিন আহমদ লেখেন, ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানের ভেতরে ঢুকে পড়েছে—এ রকম একটি খবরের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামি ঐক্য সংস্থা পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতিতে উদ্বেগ জানায়। এক বিবৃতিতে সংস্থাটি বলে, পাকিস্তান ও ভারত সরকার পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার প্রশ্নে একটি সমাধানে পৌঁছাতে সব রকমের চেষ্টা করবে। বিবৃতিতে আশঙ্কা জানিয়ে বলা হয়, পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে উভয় দেশের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ বেধে যেতে পারে।
তিনি বলেন, মরক্কোর বাদশাহ হাসান ২৪টি মুসলিম দেশের সরকারপ্রধানের কাছে এক জরুরি বার্তায় পাকিস্তান-ভারত বিরোধ মীমাংসার ব্যাপারে নিজেদের প্রভাব খাটানোর আবেদন জানান। এদিকে মরক্কোর বিরোধীদলীয় ফ্রন্ট এক বিবৃতিতে ভারত সরকারের নীতি এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের নিন্দা জানায় এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানায়। বিবৃতিতে বলা হয়, কোনো ন্যায়সংগত কারণ ছাড়াই পাকিস্তান ভারতের শিকারে পরিণত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ৯০ বছর কারাদণ্ডাদেশ পাওয়া জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম ২০১৪ সালের ২৪শে অক্টোবর রাত ১০টা ১০ মিনিটের দিকে সাবেক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ১৫ই জুলাই তাকে ৯০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। তার অপরাধ মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য হলেও বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় তাকে এই দণ্ড দেওয়া হয়।
খবরটি শেয়ার করুন