ছবি - সংগৃহীত
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং সুখবর ডটকমকে বলেন, চাক মূলত মঙ্গোলীয় জাতিগোষ্ঠীর লোক। বাংলাদেশে তাদের সংখ্যা দশ হাজারেরও কম। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যেও এই জাতির বসবাস রয়েছে। বাংলাদেশে পার্বত্য জেলা বান্দরবানের বাইশারি, নাইখ্যংছড়ি, আলিখ্যং, কামিছড়া, কোয়াংঝিরি, বাকখালী, দোছড়ি, বাদুরঝিরি, ক্রোক্ষ্যং প্রভৃতি জায়গায় চাক জনগোষ্ঠী বসবাস করে। রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে স্বল্প সংখ্যক চাক জনগোষ্ঠীর লোক চাকরির সুবাদে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করছে।
রীতিনীতি:
চাক জনগোষ্ঠীর নেতা থোয়াই ক্য জাই চাক সুখবর ডটকমকে বলেন, চাকদের ভাষা ও সংস্কৃতি খুবই সমৃদ্ধ। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে এসব হারিয়ে যেতে বসেছে। চাক জনগোষ্ঠীভুক্ত একজন পুরুষের ঔরসে জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তিই চাক পরিচয়ের অধিকারী। চাক জাতিসত্ত্বার অন্তর্ভুক্ত কোনও পরিবারে জন্মগ্রহণকারী শিশুর সামাজিক পরিচিতি চাক বলে স্বীকৃত হবে। তবে মাতাকে চাক নারী হতে হবে এমন কোনও সামাজিক বাধ্যবাধকতা নেই। চাক জনগোষ্ঠীর গ্রামীণ সমাজে দেবতা, অপদেবতা, প্রকৃতি পূজার প্রচলন লক্ষ করা যায়। এরূপ পূজার প্রচলনকে সামাজিক বিশ্বাস হিসেবে গণ্য করা হয়। পারিবারিক সুখ-শান্তি ও মঙ্গলের জন্য লক্ষ্মীপূজা অথাৎ ‘আংদা ইছা ওহে’ (আংদা ওহেক) অনুষ্ঠানের প্রচলন চাক সমাজে রয়েছে। এ পূজা দিতে একটি শুকর প্রযোজন হয়।
চাক জনগোষ্ঠী জন্ম, মৃত্যু ও বিবাহ – এই তিনটি অধ্যায়কে সামাজিক রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠান দ্বারা সমাজসিদ্ধ করা হয়েছে। তাদের সমাজে এসব রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান মেনে চলা হয়। চাক জনগোষ্ঠী জন্মান্তরবাদ, জ্যোতিষতত্ত্ব বিশ্বাস করে। পূর্ব পুরুষদের কেউ নবজাতক হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে এমন বিশ্বাস থেকে সেই পূ্র্ব পুরুষের নামানুসারে নবজাতকের নাম রাখা হয়। আবার অনেকে জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে শিশুর নাম রাখে। চাকদের প্রথম সন্তানের নামের আগে বা পরে ‘উ’ এবং সর্বকনিষ্ঠ সন্তানের নামের আগে বা পরে ‘থুই’ শব্দ ব্যবহার করা হয়।
চাক সমাজে শিশু ভূমিষ্ট হবার সময় প্রসূতিকে ঘরের আলাদা একটি কক্ষে (কাবাক বা আতং ঘরে) রাখা হয়। তবে ঘরটি স্বামী বা নিকটাত্মীয়ের ঘর হতে হবে। নয়তো প্রসূতির জন্য আলাদা ঘর নির্মাণ করে দিতে হয়। জন্মের পর ছ্রামাহ্ (ধাত্রী) শিশুকে এক টুকরা কাপড়ে জড়িয়ে স্নান করিয়ে দেয়। পরিবারে একজন বয়ষ্ক মহিলা ১টি পাত্রে কিছু ভাত ও পানি রেখে সেখানে ১টি অঙ্গলা (জ্বলন্ত কয়লা) ফেলে আতুর ঘরে নিয়ে যায়। সে পাত্রের পানিতে আঙ্গুল ভিজিয়ে নবজাতকের হাতে ও পায়ে ছোঁয়ানো হয়। পরে ভাত ও পানি এবং অঙ্গলাগুলো ঘরের বাইরে ফেলে দিতে হয়। বিশেষ কক্ষে ৮/১০ দিন থাকতে হয়। নাভীরজ্জু শুকিয়ে যাবার পর যেদিন নবজাত শিশুকে আতুর ঘরের বাইরে আনা হয় সেদিন শ্বাশুড়ি বা কোনও বয়ষ্ক মহিলা পবিত্র পানি প্রাকৃতিক উৎস ছড়া বা ঝর্ণা থেকে অন্য কেউ স্পর্শ করার আগে ভোর বেলায় নিয়ে এসে প্রসূতি মা ও শিশুর উপর ছিটিয়ে দেয়। এ সময় ডিম পাড়া একটি মুরগি রান্না করে ধাত্রীকে নিমন্ত্রণ খাওয়ানো হয়। এ খাবার ধাত্রী ছাড়া অন্য কেউ খেতে পারে না।
বিয়ের রীতি:
চাকঢালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ক্যাউতিং চাক সুখবর ডটকমকে বলেন, চাক সমাজে বিবাহ উপলক্ষে বরপক্ষকে কনের বাড়িতে তিনবার যেতে হয়। প্রথমবার পাত্রের পিতা-মাতা পাত্রীর পিতা-মাতার বাড়িতে মদ ও মুরগি নিয়ে যায়। এভাবে যাওয়াকে ‘আচংগা’ অর্থাৎ কনে দেখা বলে। দ্বিতীয়বার জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী পাত্র-পাত্রী কুষ্টিতে জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত শুভাশুভ নির্ণয়ের বিবরণ যাচাই করে। তৃতীয়বার একশ থেকে পাঁচশত ডিম উপঢৌকন নিয়ে পাত্রের মা-বাবা পাত্রীর বাড়ি নিয়ে গিয়ে বিবাহের দিন ধার্য করেন। এ সময় পাত্রীপক্ষ কনে পণ হিসেবে অলংকার, পোশাক-পরিচ্ছদ ও নানা সামগ্রী দাবি করে থাকে।
বিয়ের অনুষ্ঠানের ২দিন আগে পাত্রীর বাড়িতে তার আত্মীয়-স্বজনরা মিলিত হয়। বাড়ির উপস্থিত প্রবীণ ও বয়স্কদের উদ্দেশে পাত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে প্রণাম করে সকলের আশীর্বাদ কামনা করে। বয়োজ্যেষ্ঠ ও প্রবীণরা তাকে আশীর্বাদ করে টাকা দেয়। বিয়ের দিন বরযাত্রীরা অলংকার, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং খিলি পান, মদ মুরগি, আখ, কলা ইত্যাদি সামগ্রীসহ কনের বাড়ির আঙিনায় পৌঁছালে কনেপক্ষের একজন গিয়ে বরকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বাড়ির মাচাং ঘরে তুলে কনের কক্ষে নিয়ে গিয়ে কনে ও বরকে পরস্পরের মুখোমুখি করে বসানো হয়। তাদের সামনে বেতের তৈরি ২টি টেবিলে রাখা কলাপাতার উপর ভাত ও মদের গ্লাস এবং পাশে ২টি মদের বোতল দেয়া হয়।
বরপক্ষের আনা ২টি মুরগিকে বিনা রক্তপাতে বধ করে সে ২টির পালক, নখ ও নাড়িভূড়ি ফেলে পরিস্কার করে ধুয়ে হলুদ মেখে আস্ত সিদ্ধ করা হতে হবে। এ মুরগী বর-কনের সামনে কলাপাতায় রাখা হয়। মুরগির জিহ্বা টেনে বের করে শুভাশুভ নির্ণয় করা হয়। অনুষ্ঠানে শেষ পর্বে বরের সামনে রাখা গ্লাসে মদ ঢেলে বর নিজের মুখের কাছে নিয়ে ফুঃ ফুঃ শব্দ করে কনের হাতে তুলে দেয়। এ সময় কনে তা পান করে এবং একইভাবে কনে গ্লাসে মদ ঢেলে নিজের মুখের কাছে নিয়ে ফুঃ ফুঃ শব্দ করে বরের হাতে তুলে দেয়। এ সময় বর তা পান করে। এখানেই বিয়ের মূল অনুষ্ঠান (মংনাঙ পো) সম্পন্ন করা হয়। সামাজিক রীতি অনুসারে মদ পান করে স্বামী-স্ত্রীরূপে স্বীকৃতি অর্জন করে।
সৎকার রীতিঃ
আদিবাসী নেতা ক্যচিং চাক সুখবর ডটকমকে বলেন, চাক সমাজে মৃতদেহ সৎকারের জন্য প্রচলিত নিয়ম বা রীতিকে ‘আপেংজা’ (দেহ অধিকার প্রথা) বলে। সমাজের রীতি অনুসারে মৃতদেহ দাহ্য করার দায়িত্ব যার উপর বর্তায় যদি তিনি উপস্থিত থেকে দায়িত্ব পালন না করেন এবং অনুপস্থিত থাকেন তাহলে সমাজের কাছে তাকে জবাবদিহি করতে হয়। চাক সমাজে কারো মৃত্যু হলে তার আত্মার শান্তি কামনা করে ধর্মীয় পুস্তক পাঠ এবং ঢোল, মং ইত্যাদি বাজানো হয়। মৃত ব্যক্তিকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার আগে স্নান করানো হয়। মৃতদেহ বাঁশের খাটিয়াতে তুলে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে উপস্থিত সকলে বৌদ্ধ ভিক্ষুর কাছে পঞশীল গ্রহণ করে। এরপর মৃতদেহের উপর পবিত্র পানি ছিটিয়ে চিতায় তুলে অগ্নিসংযোগ করা হয়। মৃত্যুর এক বছর পূর্ণ হবার আগে আত্মীয়স্বজন ও সমাজের লোকজনকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে হয়।
চাক নৃ-জনগোষ্ঠীর আদি সংস্কৃতিঃ
আদিবাসী নেতা ক্যচিং চাক সুখবর ডটকমকে বলেন, চাক সম্প্রদায়ের আদি সংস্কৃতি ও উৎসবের মধ্যে রয়েছে- বৈসাবি, সাংগ্রাইং, ফাইতা, বুদ্ধ মূর্তি স্নান করানো, দুতিয়ারিযা, ওয়াঙ্গাবা। তাদের মাতৃভাষায় রচিত বিভিন্ন গান ও আদি নৃত্য। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চাকরা ৪/৫ দিন ধরে সাংগ্রাইং উৎসব পালন করে থাকে। চাকদের ভাষায় সাংগ্রাইংয়ের প্রথম দিনকে ফাইতার মারিয়া, দ্বিতীয় দিন দুতিয়ারিয়া, তৃতীয় দিনকে সাংগ্রাইংফু বলে থাকে। তারা এসব অনুষ্ঠান ব্যাপক আয়োজনের মাধ্যমে পালন করে থাকে।
আদিবাসী নেতা উৎপল চাকমা সুখবর ডটকমকে বলেন, অর্থনৈতিক ও শিক্ষার দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে চাক সম্প্রদায়। তারা অত্যন্ত শান্তিপ্রিয়। সংখ্যায় কম হলেও তাদের অনেকে এখন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত চাকদের মধ্যে শিক্ষার আলো বেশি ছড়িয়েছে। মিশনারীদের সহায়তায় তারা নানাভাবে স্বাবলম্বী হতে শিখছে। উৎপল চাকমা আরও বলেন, সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে চাক জাতির অস্তিত্ব রক্ষা পেতে পারে।