ছবি: সংগৃহীত
অভাবী কৃষক পরিবারের ছেলে চিত্তরঞ্জনের লেখাপড়া বেশিদূর এগোয়নি। তিন বছর বয়সে হারিয়েছেন মাকে আর ২০ বছর বয়সে মারা গেছেন বাবাও। বাবার শেখানো ও আমেরিকার এক বিজ্ঞানির বক্তব্য শুনে তালবীজ রোপণ শুরু করেন তিনি। মৃত্যুর আগে বাবা চিত্তরঞ্জনকে শিখিয়েছিলেন ‘বজ্রনিরোধক’ তালবীজ রোপণ করার পদ্ধতি। সেই শিক্ষা এখন যশোরের অভয়নগর উপজেলাব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি।
উপজেলার ধোপাদী গ্রামের দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা চিত্তরঞ্জন দাস গত ১৬ বছরে রোপণ করেছেন পৌনে তিন লাখ তালবীজ। এর মধ্যে প্রায় এক লাখ তালগাছ ছায়া দিচ্ছে এই অঞ্চলে। তালগাছপ্রেমী চিত্তরঞ্জন দাসের বয়স প্রায় ৬৭ বছর। যশোরের অভয়নগর উপজেলার সবাই তাকে চেনেন ‘তালগাছ প্রেমিক চিত্তরঞ্জন দাস’ ওরফে চিত্ত দা নামে। ধোপাদী নতুন বাজার এলাকায় সরদারবাড়ির সামনে নারিকেল ও তালগাছের চেরাই করা বাতা বিক্রি করে সংসার চলে চিত্তরঞ্জন দাসের।
সুযোগ পেলে চিত্তরঞ্জনের সাইকেলের হ্যান্ডেলে থাকে সারের বস্তা দিয়ে তৈরি একটি ব্যাগ। তার মধ্যে তালবীজ, গামছা, করাত, পানিভর্তি বোতল ও একটি দা। রাস্তা, পুকুর ও রেললাইনের পাশে বজ্রনিরোধক তালবীজ রোপণ করেন তিনি। রোপণের পর নিজ হাতে করেন পরিচর্যা। আর সারাবছর এই গাছের দেখভাল করেন। তিনি এসবই করেন স্বেচ্ছাশ্রমে।
তালগাছ প্রেমিক চিত্তরঞ্জন দাস জানান, ভাদ্রমাসে তাল পাকে। ভাদ্র ও আশ্বিন এই দুই মাস তিনি তালবীজ রোপণে পুরোটা সময় দিয়ে থাকেন। নিজের জমানো টাকা দিয়ে ভবদহ অঞ্চলের ৫০টি গ্রাম থেকে তালবীজ ক্রয় করেন তিনি। এছাড়া প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে বাসাবাড়ি এবং আবর্জনার স্তুপ ঘেঁটেও তালবীজ সংগ্রহ করেন। এরপর সেগুলো সংরক্ষণ করে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকায় গিয়ে তা রোপণ করেন। প্রতিবছর ভাদ্র-আশ্বিন দু’মাসে গড়ে প্রায় ২০ হাজার তালবীজ রোপণ করেন। এ হিসেবে ২০০৮ সাল থেকে ১৬ বছরে দুই লাখ ৮৮ হাজার তালবীজ ও ৫৬ হাজার খেজুরবীজ রোপণ করেছেন তিনি।
অভয়নগর উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন ও নওয়াপাড়া পৌর এলাকার ৪২টি ছোট-বড় রাস্তায় এসব বীজ রোপণ করেছেন তিনি। এছাড়া অসংখ্য পুকুর ও নদীর পাড়েও তালবীজ রোপণ করলেও যার হিসাব তিনি নিজেও রাখতে পারেননি। তবে সমাজের কিছু মানুষ তার রোপণ করা তালবীজের চারা উপড়ে ফেলে নষ্ট করেছেন। তালপাখা তৈরির জন্য প্রতিনিয়ত গাছের পাতা কাটছেন হাতপাখার ব্যবসায়ীরা। যা পরিবেশ ও গাছের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর ভবদহ অঞ্চল দীর্ঘদিন জলাবদ্ধ থাকায় ওই সময়ে লক্ষাধিক তালগাছ মারা গেছে। এখনও প্রায় এক লাখ গাছ বেঁচে আছে বলে জানান চিত্তরঞ্জন দাস।
তিনি উল্লেখ করেন, এই কাজের জন্য মাঝে মধ্যে কিছু আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। সম্প্রতি অভয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কে এম আবু নওশাদের পক্ষ থেকে খাদ্যপণ্যসহ কিছু উপহারসামগ্রী ও খেজুরবীজ ক্রয়ের জন্য নগদ ৫ হাজার টাকা পেয়েছেন।
আরো পড়ুন: বাঁশ ফুলের বীজ থেকে তৈরি হচ্ছে খাওয়ার উপযোগী চাল
চিত্তরঞ্জন আরো জানান, তিনি প্রতিদিন সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের রোপণ করা গাছ পরিচর্যা করতে সাইকেল চালিয়ে ছুটে যান বিভিন্ন গ্রামে। স্থানীয় গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে গাছ বাঁচানোর চেষ্টা করেন। কোথাও তালবীজের খোঁজ পেলে ছুটে যান সেখানে। খুশি হয়ে বিনামূল্যে কেউ বীজ দিলে তা নিয়ে নেন, না হলে টাকা দিয়ে কিনে নেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিজ ব্যবসার ফাঁকে তালবীজ সংগ্রহে ব্যস্ত থাকেন তিনি।
অভয়নগরের ধাপাদি গ্রামের ইব্রাহিম হোসেন জানান, নিজ তাগিদ থেকে চিত্তরঞ্জন রোপণ করেন তালবীজ। উপজেলার অসংখ্য গ্রামে তিনি তালবীজ রোপণ করেছেন। তার লাগানো তাল গাছের নিচে বসে পথচারীরা বিশ্রাম নেন। মাঠের কৃষক ক্লান্ত শরীর নিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে একটু স্বস্তি পান।
অভয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কে এম আবু নওশাদ বলেন, চিত্তরঞ্জন দাস অভয়নগর এলাকায় তালবীজ রোপন করে সাড়া ফেলেছেন। এ অঞ্চলে তার লাগানো প্রচুর গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে সাক্ষী দিচ্ছে। তার এই উদ্যোগ সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার।
এসি/ আই.কে.জে/