রবিউল হক
পঞ্চগড় জেলার লোকসাহিত্য ও লোকঐতিহ্য বেশ সমৃদ্ধ। লোকসাহিত্যের নানা উপাদানে পরিপূর্ণ উত্তরের এ জেলা। লোকসাহিত্যের একটি অন্যতম প্রাচীন ও স্বতন্ত্র শাখা হলো ধাঁধা। ধাঁধা লোকায়ত জনপদে বুদ্ধি, মনন, মেধা ও জীবন দর্শনের ঐতিহ্যবাহী ভাণ্ডার হিসেবে বিবেচিত।
আমাদের গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় নর-নারী, প্রকৃতি, গার্হস্থ্য জীবন, পশুপাখি, কাহনী, সংখ্যা ইত্যাদি বিষয়ে ধাঁধা জিজ্ঞেস করার নিয়ম বেশ প্রচলিত। প্রশ্ন পদ্ধতির ভিত্তিতে বুদ্ধি, কল্পনা, কৌতূহল, রসবোধ মিলে ধাঁধায় একটি শিল্পিত মনের ছাপ ফুটিয়ে তোলা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে ধাঁধার চর্চা হয়ে চলেছে মূলত বিবাহ উপলক্ষে বর ও কনের উপস্থিত জ্ঞান নির্ণয়ে, বিয়ে বাড়িতে বর ও কনে পক্ষের মধ্যে আমোদ-প্রমোদের অভিপ্রায়ে, গ্রামের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে অবসর সময় অতিবাহিত করার মাধ্যম হিসেবে, এমনকি অক্ষরজ্ঞান শিক্ষামূলক এবং তা কখনো কখনো গৃহস্থালি কাজ-কর্মের মধ্যেই বিনোদনের মাধ্যমরূপে।
পঞ্চগড় জেলার বিভিন্ন স্থানে এসকল সামাজিক অনুষ্ঠানাদি ও গৃহস্থালি কাজ-কর্মের অবসরে ধাঁধা চর্চা বেশ প্রচলিত। পঞ্চগড় জেলার লোকসংস্কৃতির মধ্যে প্রবাদ-প্রবচন বেশ সমৃদ্ধ। প্রবাদ সাহিত্যের মধ্যে একটি জাতির চিন্তার গভীরতা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা সম্ভব। এছাড়া, জীবন ব্যাখ্যা ও শিল্পচেতনায় প্রবাদ-প্রচলনগুলো সমাজ ও সমাজে বসবাসকারী মানুষের শিল্পবেদনাকে গভীর অন্তর্দৃষ্টির মধ্যদিয়ে উপস্থাপন করে থাকে। গ্রামবাংলায় প্রচলিত প্রবাদ-প্রবচন লোকজীবনে চিত্তবিনোদনের খোরাক, আর এটি লোকশিক্ষা ও জ্ঞানের অন্যতম বাহন হিসেবে কাজ করে থাকে। আজো উত্তরের এ অঞ্চলের বয়স্ক ব্যক্তি ও নারীদের মধ্যে প্রবাদ-প্রবচনের প্রচলন দেখতে পাওয়া যায়।
মিশরে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব পাঁচশত অব্দে প্যাপিরাসে লিখিত গল্পে প্রবাদের উল্লেখ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। প্রবাদে প্রতিফলিত বিচিত্র বিষয়ের মধ্যে স্বাস্থ্যবিষয়ক, কৃষিবিষয়ক প্রবাদের অতিরিক্ত প্রকাশভঙ্গি না থাকলেও প্রবাদের আসল উদ্দেশ্য মানুষের বিচিত্র চরিত্র রূপায়ন করা। প্রবাদের শুদ্ধ চর্চার মাধ্যমে মানুষের ভাবের গভীরতা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া শাণিত হয় বিবেক ও মুদ্ধিমত্তা। জ্ঞানের গভীরতা নির্ণয়, ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা, অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ এবং বক্তব্যের সংক্ষিপ্ত রূপ অলংকার হিসেবে প্রবাদে বহুল ব্যবহৃত। এসব প্রবাদ-প্রবচনে মানুষের মন্দ দিকগুলোই মূলত বর্ণিত হয়ে থাকে। যেমন- ‘কেরোসিনের গন্ধ নাই নাম আতর আলী’। আবার গ্রামের অলস ব্যক্তির সম্পর্কে প্রবাদ-প্রবচনে বলা হয়েছে-‘কটিত নাই হেরা, বান্ধিবা যাছে ঘেরা’ (যার পরিধান করার কাপড় নেই, সে যায় বেড়া বাঁধতে)। এ অঞ্চলের প্রবাদ-প্রবচনে সতীন সম্পর্কে নারীর চিন্তাভাবনায় রয়েছে ভিন্ন মত। যেমন-‘দুই সতীনের ঘরে, ভাতার উল্টে পড়ে’। কৃষি সম্পর্কিত প্রবচনে বলা হয়েছে- ‘অঘন পোষে বিষ্টি, আম কাঁঠালের সিষ্টি’ (অগ্রহায়ণ-পোষ মাসে বৃষ্টি, আম কাঁঠালের ফলন), ‘কার বেটির কেনং ঢঙ, দেখা যাবে দেবীর বাজারত’ (কার কতো রূপ সেটা পূজোয় বা মেলায় দেখতে পাওয়া যায়।)
তথ্যসূত্র :
১. নাজমুল হক, উত্তরবঙ্গের লোকসাহিত্যের নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক সমীক্ষা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০৭
২. মাযহারুল ইসলাম তরু, চাপাইনবাবগঞ্জের লোকসংস্কৃতির পরিচিতি, বাংলা একাযডেমি, ঢাকা, ১৯৯৯
৩. মুহম্মদ আবদুল জলিল, বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চার ইতিবৃত্ত, অনার্য, ঢাকা, ২০১১
৪. তপন বাগচী, লোকসংস্কৃতির কতিপয় পাঠ, গকতিধারা, ঢাকা, ২০০৮
রবিউল হক, লোক গবেষক ও শিল্পী
আই.কে.জে/