সোমবার, ১৬ই জুন ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১লা আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

যেভাবে ভোর হয় তেহরান ও তেল আবিবে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ০৭:৩৫ অপরাহ্ন, ১৫ই জুন ২০২৫

#

ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত হানে ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিবের রামাত গেন এলাকায়ও। ছবি: এএফপি

গত শুক্রবার (১৩ই জুন) ভোররাতে ইসরায়েলের প্রথম মিসাইল আঘাত হানার সময় ঘুম ভেঙে উঠে শাহরাম দেখেন, তার আশ্রয় নেওয়ার মতো নিরাপদ কোনো জায়গা নেই। তেহরানের একটি আবাসিক ভবনে স্ত্রীসহ বাস করেন এ সাংবাদিক। ঘরের ভেতরে একটি খাবার টেবিলের নিচে লুকিয়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেন। বিস্ফোরণে সে সময় দুলছিল দেয়াল, কাঁপছিল জানালা।

শাহরাম বলেন, ‘এমন সন্ত্রাস আমি আগেও একবার অনুভব করেছি, ৮০-এর দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধে যখন বাগদাদের মিসাইল তেহরানে এসে পড়েছিল। তখন অন্তত সাইরেন ও শেল্টার ছিল। এখন কিছুই নেই।’ খবর এএফপির।

এ দৃশ্যের প্রায় ১ হাজার ২০০ মাইল দূরে গতকাল শনিবার (১৪ই জুন) সকালে ইসরায়েলের তেল আবিব শহরের বাসিন্দারা ঘর থেকে বেরিয়ে দেখতে পান এক অন্য রকম শহর—ফাঁকা রাস্তা, দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া গাড়ি, ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসাবশেষ। তেহরান ও তেল আবিব—দুই শহরই এবার সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে।

বছরের পর বছর ইয়েমেন থেকে লেবানন পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে আসা ইরান ও ইসরায়েল এবার সরাসরি একে অন্যকে লক্ষ্য করে মিসাইল ছুড়ছে। ইসরায়েলের হামলায় তেহরানের অনেক জায়গায় ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি হয়েছে।

তেহরানের শাহরারা এলাকায় থাকতেন কবি ও ইংরেজি শিক্ষিকা পারনিয়া আব্বাসি। ২৩ বছর বয়সী এ কবি সপরিবারে নিহত হয়েছেন। তার রক্তাক্ত শরীর ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে ছিল। ইসরায়েলি মিসাইল একাধিক ভবন গুঁড়িয়ে দিয়েছে, মারা গেছে দুই মাস বয়সী শিশু ইয়ারান ঘাসেমি, প্যাডেল খেলোয়াড় পারসা মনসুর, আলবোরজ অঞ্চলের ঘোড়দৌড় দলের সদস্য মেহদি পুলাদভান্দসহ আরও অনেকে।

এদিকে ইরানের পাল্টা হামলার পর ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিবের স্টার্টআপকর্মী ইয়ায়েল ওয়েইনরেব বলেন, ‘এ বিস্ফোরণের শব্দ ছিল অন্য রকম। আশ্রয়কেন্দ্রে বসেই আমরা দেখেছি, শহরে আঘাত হানার সেই মুহূর্ত।’

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত শুক্রবার সকালে জাতির উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘নিরাপদ আশ্রয়ে দীর্ঘ সময় থাকার জন্য প্রস্তুত থাকুন। খাবার, পানি ও ধৈর্য মজুত রাখুন।’

তেল আবিবের বেশিরভাগ ভবনে নিরাপদ কক্ষ নেই। ইরিত নামের এক তথ্যচিত্র নির্মাতা বলেন, ‘তৃতীয় হামলার আগে কোনো সতর্কতা পাওয়া যায়নি, শুধু সাইরেন শুনে আমরা বাড়ির বাইরে ছুটে যাই। কোথায় মিসাইল পড়বে, সেটা ছিল শুধু ভাগ্যের ব্যাপার।’

তেহরানের মধ্যাঞ্চলের এক কেকের দোকানে কাজ করেন আমিন। তার বাসা ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনির বাসভবনের কাছেই। গতকাল শনিবার ভোরে বিস্ফোরণের সময় তার ঘরটি ভূমিকম্পের মতো কাঁপছিল।

আমিন বলেন, ‘আমি ধরে নিয়েছিলাম, আগের মতো সামরিক স্থাপনায় আঘাত হেনেছে। কিন্তু এবার চারপাশে বিস্ফোরণ চলছিল। আমি ভয় পেয়ে ডকুমেন্টস, ল্যাপটপ ব্যাগে ভরে দরজায় বসে থাকি।’ সকাল ৯টায় কাজে গেলেও পথে সেনাসদস্যদের ব্যাপক উপস্থিতি দেখেছেন তিনি। তবে দোকান, ক্যাফে খোলা ছিল। পেট্রলপাম্পে লাইন ছিল বেশি।

ইসরায়েল টার্গেট করেছে তেহরানের উত্তর-পূর্বের বিলাসবহুল এলাকাগুলোকেও। লুই ভুইতন, শোপার্ডের মতো দোকানে নিয়মিত কেনাকাটা করা ইরানের অভিজাতরা এবার যুদ্ধের বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন।

উত্তর তেহরানের গৃহবধূ মরিয়ম বলেন, ‘আমাদের পাশের ভবনে আঘাত হেনেছে। জানালা কেঁপে উঠেছিল। রাস্তায় মরদেহ পড়ে ছিল। এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না।’

ইসরায়েলি হামলায় ইরানের নাতানজ শহরের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রও আক্রান্ত হয়েছে। তাই শহরের বাইরে যাতায়াত বন্ধ। প্রায় ৫০ হাজার মানুষ কার্যত বন্দী।

পরমাণুকেন্দ্র থেকে তেজস্ক্রিয়তা ছড়ালে কী করতে হবে, সেই বিষয়ে কোনো গাইডলাইন দেওয়া হয়নি। অনেকে মনে করছেন, নাতানজ ইরানের চেরনোবিল হতে পারে।

গত শুক্রবার রাতে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সক্রিয় হলেও আগের রাতে তারা কেন নিষ্ক্রিয় ছিল, সেই প্রশ্ন উঠেছে। গতকাল সকাল পর্যন্ত বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল রাজধানীবাসীর। পুলিশ ব্যবসায়ীদের দোকান বন্ধ রাখতে অনুরোধ করে। এর ফলে কার্যত লকডাউনে ছিল শহরটি।

গত শুক্রবার রাতে ইরানে ৭৮ জন নিহত হলেও ইসরায়েলে প্রাণ গেছে তিনজনের, আহত ৭৬। সামরিক বাহিনী সতর্ক করেছে, এ ধরনের হামলা আরও দিনের পর দিন চলতে পারে। আকাশপথও দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকতে পারে।

তেল আবিব শহরে একটি বিয়েতে অংশ নিতে এসে পরিবার নিয়ে আটকা পড়েছেন ডেভিড সিল নামের এক ব্রিটিশ। তিনি বলেন, ‘আগে হেঁটে বেড়িয়েছি, রেস্তোরাঁতে খেয়েছি। এখন যুদ্ধক্ষেত্রে আছি। রাত ৩টার সময় বোম শেল্টারে গিয়ে ফোনে খবর দেখি—তেল আবিবে আঘাত লেগেছে। ঘুমাতে পারিনি, বারবার জেগে উঠেছি। এখন বাড়ি ফিরতে চাই, কিন্তু কীভাবে ফিরব, জানি না।’

নেতানিয়াহু ইরানিদের আহ্বান জানিয়েছেন, নিজেদের সরকার পতনে এগিয়ে আসতে। কিন্তু ইরানিরা এ আহ্বান ঘৃণা নিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন। সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা মিনা আকবারি ইনস্টাগ্রামে লিখেছেন, ‘যারা ইরানকে যুদ্ধের মাধ্যমে মুক্ত করতে চায়, তারা ইতিহাস জানে না বা ধ্বংস থেকে মুনাফা পায়। গণতন্ত্র ফাইটার জেটে আসে না, আসে মানুষের আন্দোলনে।’

এইচ.এস/

তেল আবিব তেহরান ইরান-ইসরায়েল সংকট

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন