ছবি: সংগৃহীত
চাকরির খোঁজে রাজধানীতে এসে ফুটপাতে শুয়ে পার করেছেন রাতের পর রাত। একসময় নিজ গ্রামে মাটি কাটা শ্রমিকের কাজ করেছেন। পরে বহু চেষ্টা-তদবিরে একসময় ভাগ্য খোলে। বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) পরিচালকের গাড়িচালক হিসেবে নিয়োগ পান। পরবর্তী সময়ে দায়িত্ব পান পিএসসি চেয়ারম্যানের গাড়ি চালানোর। চাকরি পেয়েই শূন্য থেকে শতকোটি টাকার মালিক হন আলোচিত আবেদ আলী।
এর নেপথ্যে রয়েছে পিএসসির অধীনে বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস। গাড়িচালক হয়ে পিএসসিতে ঢোকার পরই আবেদ আলী প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে যুক্ত হন। অভিযোগ আছে, বছরের পর বছর ধরে বিসিএস পরীক্ষাসহ বিভিন্ন চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করে কামান শতকোটি টাকা। আর সেই টাকায় বিলাসী জীবনযাপনের পাশাপাশি গড়েছেন একের পর এক সম্পদ। দামি বাড়ি, গাড়ি, প্লট-ফ্ল্যাট, এমনকি তৈরি করেছেন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স কোম্পানিও। এখন নিজেকে পরিচয় দেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে।
পিএসসির তিনটি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর সোমবার (৮ই জুলাই) আবেদ আলী ও তার ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়ামসহ ১৭ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
আরো পড়ুন: প্রশ্নফাঁস: পিএসসির দুই উপপরিচালক ও আবেদ আলীসহ গ্রেফতার ১৭
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার পশ্চিম বোতলা গ্রামের মৃত আব্দুল রকমান মীরের তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সৈয়দ আবেদ আলী ওরফে জীবন মেজো ছেলে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকায় জীবিকার তাগিদে ঢাকায় আসেন তিনি। এরপর ভাগ্য খুলে যায় গাড়িচালকের চাকরি পেয়ে। যিনি নিজে গাড়িচালক ছিলেন, সেই আবেদ আলীর নিজেরই এখন রয়েছে কয়েকজন গাড়িচালক।
অভিযোগ আছে, ৩৩তম থেকে ৪৫তম বিসিএস পর্যন্ত প্রশ্নফাঁসের প্রক্রিয়া সঙ্গে জড়িত চক্রে সক্রিয় ছিলেন আবেদ আলী। এভাবে বিপুল পরিমাণ টাকা বাগিয়ে হয়ে গেছেন গ্রুপ অব কোম্পানির মালিক। গ্রামে তৈরি করেছেন ডুপ্লেক্স বাড়ি। পাশে নিজের নামে তৈরি করেছেন মসজিদ। রয়েছে ডেইরি ফার্ম ও বাগানবাড়ি। রাস্তার পাশে সরকারি জায়গা দখল করে তৈরি করেছেন মার্কেট। নিজ এলাকায় শতবিঘার ওপরে জমি কেনার পাশাপাশি কুয়াকাটায় তৈরি করেছেন থ্রি স্টার হোটেল সান মেরিনো। ঢাকার মিরপুর ও উত্তরায় রয়েছে দুটি বহুতল বাড়ি। তথ্য বলছে, ঢাকার বিভিন্ন স্থানে তার রয়েছে অন্তত সাতটি ফ্ল্যাট এবং তিনটি প্লট।
বিভিন্নসূত্রে জানা যায়, আবেদ আলীর বড় ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম পড়াশোনা করেছে শিলিগুড়ির একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। সেখানেও একটি বাড়ি কিনেছেন আবেদ। দেশে ফিরে সিয়াম একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। বাবার টাকায় কেনা একাধিক ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন তিনি।
আবেদ আলীর গ্রামের লোকজন বলছেন, একজন ড্রাইভারের এমন রহস্যময় উত্থান অনেকের কাছেই বিস্ময়কর। বছর তিনেক আগে ডাসার উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থিতা ঘোষণা করে এলাকায় আলোচনায় আসেন আবেদ আলী। এর আগে প্রায় দেড় যুগ গ্রামে তেমন একটা আসতেন না তিনি। প্রার্থিতা ঘোষণার পরে নিয়মিত এলাকায় যান। দান-খয়রাত করেন বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে।
জানা গেছে, রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে ছাত্রলীগের তিনটি ইউনিটের পদ বাগিয়ে নিয়েছেন আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম। তিনি একাধারে ডাসার উপজেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি, ভারত শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি এবং ঢাকা উত্তর মহানগর ছাত্রলীগের ত্রাণ ও দুর্যোগ সম্পাদক পদেও দায়িত্ব পালন করছেন।
ডাসার উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ অনিক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সৈয়দ সোহানুর রহমান ডাসার উপজেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি। তাকে ছাত্রলীগের কোনো প্রোগ্রামে কোনোদিন পাইনি। নামমাত্র পদে আছে। জেলা ছাত্রলীগের নেতাদের মাধ্যমে সে উপজেলা ছাত্রলীগের পদ পেয়েছে। আমরা কেউ তাকে নেতা বানাইনি।’
ডাসার উপজেলা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা গণমাধ্যমকে জানান, ফেসবুকে নিজেকে মানবতার ফেরিওয়ালা হিসেবে নিজের পরিচয় দেন সিয়াম। বাবার অবৈধ অর্থে বিলাসী জীবনযাপন তার। একাধিক ব্যক্তিগত গাড়ি রয়েছে সিয়ামের। সেসব গাড়ি নিয়ে সে এলাকায় প্রায়ই আসে। এলাকায় দান করে সেগুলোর ভিডিও তৈরি করে ফেসবুকে প্রচার করে। রাজনৈতিক কোনো প্রোগ্রামে না থাকলেও এলাকায় বিভিন্ন ব্যানার-ফেস্টুন করেছেন। উপজেলা ছাত্রলীগের পদ নিয়ে আবার ঢাকায় গিয়েও পদ নিয়েছে।
জানা গেছে, আবেদ আলী নিজেকে প্রভাবশালী প্রমাণের জন্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা লোকদের সঙ্গে তার ওঠাবসা বলে এলাকায় প্রচার করতেন। তিনি বলতেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সর্বোচ্চ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করে নিজেকে ক্ষমতাবান হিসেবে জাহির করতেন তিনি। এছাড়া এলাকায় প্রচার করতেন তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে। দীর্ঘ সাধনায় তৈরি করেছেন ব্যবসার সাম্রাজ্য।
ডাসারের স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুল আলীম গণমাধ্যমকে বলেন, একজন গাড়িচালকের হঠাৎ করে এত সম্পদের মালিক হওয়ার পেছনে যে নিশ্চয়ই কোনো দুর্নীতি আছে, সেটি আগেই বোঝা যাচ্ছিল। তবে সে যে এত বড় প্রতারক সেটি ভাবতে পারিনি। এলাকায় নির্বাচনের সময় মানুষকে উপদেশ দিয়ে বেরিয়েছেন। তিনি নাকি নিজের রক্ত পানি করে, শ্রম-ঘাম দিয়ে এত সম্পদ অর্জন করেছেন। মানুষকে বলেছেন সততার সঙ্গে যেন কাজ করে। সে যে এত বড় প্রতারক, সেটা শুরুতে বোঝা যায়নি।
আব্দুল আলীমের কথার সত্যতা মেলে আবেদ আলী এবং তার ছেলে সিয়ামের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক আইডিতে। নিজের ফেসবুকে আবেদ আলী লিখেছেন, ‘আমি একজন অতি সাধারণ খেটে খাওয়া দিনমজুর মানুষ।’
এছাড়া তার ফেসবুক ওয়ালে রয়েছে বিভিন্ন নীতিবাক্য সংবলিত স্ট্যাটাস। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘আমার জীবনে কোনোদিন অসদুপায় অবলম্বন করিনি। গায়ে খেটে ভাগ্য পরিবর্তন করেছি।’
আবেদ আলীর উত্থান নিয়ে সম্প্রতি এক সমাবেশে তার ছেলে সিয়াম বলেন, ‘আমার বাবা একদম ছোট থেকে বড় হয়েছেন। আমার বাবার বয়স যখন ৮ বছর, তখন পেটের দায়ে ঢাকায় চলে যান। ঢাকায় গিয়ে কুলিগিরি করে ৫০ টাকা রুজি দিয়ে তার ব্যবসা শুরু করেন। এখন তিনি একটি লিমিটেড কোম্পানির মালিক। কষ্ট করে বড় হয়েছেন।’
দুর্নীতি দমন কমিশনের মাদারীপুর সমন্বিত কার্যালয়ের উপপরিচালক আতিকুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে কেউ অভিযোগ দিলে আমরা প্রধান কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করব।’
এইচআ/