শুক্রবার, ৫ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২১শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিয়ে ও সন্তানে কেন আগ্রহ হারাচ্ছেন কোরিয়ানরা?

মো. হাবিবুল আলম

🕒 প্রকাশ: ০৪:০৫ অপরাহ্ন, ৫ই মার্চ ২০২৪

#

ছবি: সংগৃহীত

৩৯ বছরের স্টেলার শিনের ছয় বছরের বিবাহিত জীবন। শিক্ষকতা করছেন একটি স্কুলে। স্টেলার এবং তার স্বামী উভয়েই একটি সন্তান চেয়েছিলেন। কিন্তু কাজ করতে এবং নিজেকে উপভোগে এতই ব্যস্ত ছিলেন যে সময়টি চলে যায়। তিনি স্বীকার করছেন, তার জীবনধারা এখন সন্তান নেয়াকে "অসম্ভব" করে তুলেছে।  

‘মায়েদের প্রথম দুই বছর তাদের সন্তানের পুরো সময় দেখাশোনা করার জন্য কাজ ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু এটি আমাকে খুব বিষন্ন করে তুলবে। আমি আমার ক্যারিয়ার এবং নিজের যত্ন নিতে ভালোবাসি। যদি কাজ ছেড়ে পরিবার শুরু করি, আবাসনের খরচ চালাতে পারব না’। 

সন্তান নেয়ার ব্যাপারে কেন অনীহা এমন প্রশ্নের উত্তরে এমনটাই বলছিলেন তরুণ এই শিক্ষক। 

স্টেলারের মতো আরো অনেক কোরিয়ান নারী চাকুরির নিরাপত্তা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, আবাসন সংকটের কারণে বিয়ে করা ও সন্তান জন্ম দেয়ায় অনীহা প্রকাশ করছেন। এই প্রবণতার আরো উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ হলো সন্তানের পড়াশোনার খরচ, সমঝোতার অভাব।  

গবেষকরা দাবি করছেন, কোরিয়ান নারীরা পরিবার আর চাকুরির মধ্যে চাকুরিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। আর এই ধরণের প্রবণতার প্রভাব সরাসরি পড়ছে দেশটির জন্মহার ও সার্বিক অর্থনীতিতে। 

৩০ বছর বয়সী ইয়েজিন পেশায় একজন টেলিভিশন প্রযোজক। পাঁচ বছর আগে বৈবাহিক সর্ম্পকে না যাওয়া এবং  সন্তান না নেয়ার মতো জীবনের কঠিন সিদ্ধান্ত নেন কোরিয়ান এই তরুণী। 

‘কোরিয়াতে এমন একজন পুরুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন যিনি কাজ এবং শিশুর যত্ন সমানভাবে ভাগ করবেন। আমি আমার কাজকে ভালোবাসি, এটি আমাকে পরিপূর্ণতা এনে দেয়। সেজন্য আমি ক্যারিয়ার গড়ার দিকেই বেশি মনোনিবেশ করছি। আর যাই হোক সন্তানকে বড় করার জন্য এই চাকুরি আমাকে যথেষ্ট সময় দেয় না’। 

‘আমি যে মহিলার সাথে কথা বলেছি তিনিও একই ভয় করেন। যদি সে সন্তানের জন্য চাকুরি থেকে সময় নেয়, তাহলে সে হয়তো কাজে ফিরে আসতে পারবে না। কোম্পানি থেকে চাপ রয়েছে, যখন আমার সন্তান হবে, তখন আমাদের চাকুরি ছেড়ে দিতে হবে। আমি আমার বোন এবং দুই প্রিয় সংবাদ উপস্থাপকের সাথে এটি ঘটতে দেখেছি ’। 

চাকুরি না পরিবার কোনটি বেছে নিবেন এমন প্রশ্নের উত্তরে বলছিলেন প্রযোজক ইয়েজিন। 

আশঙ্কাজনকভাবে কমছে জন্মহার 

বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে কম জন্মহারকে একটি প্রধান সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দক্ষিণ কোরিয়াও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। দেশটিতে জন্মহার সারাবিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন। 

তবে আরো উদ্বেগজনক তথ্য হলো, এই হার ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে এই হার আট শতাংশ কমে শূন্য দশমিক সাতে দাঁড়িয়েছে। উল্লেখ্য, কোনো দেশের জন্মহার ২ দশমিক ১ হলে একে স্বাভাবিক অবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 

অনুমান করা হয়, সন্তান নেয়ার এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২১০০ সালে দেশটির জনসংখ্যা অর্ধেকের কোটায় নামবে। সরকারি তথ্যানুসারে, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে দেশটিতে কর্মক্ষম লোকের পরিমাণ হ্রাস পেয়ে অর্ধেক হবে। অন্যদিকে প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা ৬৫ বছরের বেশি বয়সী হবে।  

এই পরিসংখ্যান দেশের অর্থনীতি, পেনশন স্কিম এবং নিরাপত্তার জন্য এতটাই উদ্বেগজনক যে রাজনীতিবিদরা এটিকে "জাতীয় জরুরি অবস্থা" হিসেবে ঘোষণা করেছেন। 

কাজ করেনি প্রণোদনা প্যাকেজ  

কোরিয়ান সরকার দেশটির জন্মহার বাড়াতে গত ২০ বছর একটানা কাজ করেছে। ব্যয় করেছে ২৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিভিন্ন রকমের উদ্যোগের পেছনে এই অর্থ খরচ হয়েছে। যেমন, যেসব দম্পতিদের সন্তান রয়েছে তাদের নগদ অর্থ প্রদান করা, ভর্তুকিযুক্ত আবাসন নিশ্চিত করা, ফ্রি ট্যাক্সি সরবরাহ করা, হাসপাতালের বিল পরিশোধ ইত্যাদি। 

তবে এই ধরণের আর্থিক প্রণোদনা ব্যর্থ হয়েছে। এই অবস্থায় রাজনীতিবিদরা আরো "সৃজনশীল" সমাধান নিয়ে ভাবছেন। যেমন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আয়া নিয়োগ করা, তাদের ন্যূনতম মজুরি প্রদান করা এবং ৩০ বছরের আগে যদি কারো তিন সন্তান থাকে তাহলে তাকে (পুরুষকে) সামরিক চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া। 

দেশটিতে নারী-পুরুষ উভয়ই তাদের সন্তানের জীবনের প্রথম আট বছরে মোট ৩৬৫ দিন ছুটি পান। তবে পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ছেলেদের তুলণায় মেয়েরাই এই সুবিধা বেশি নিয়েছেন। যেমন, ২০২০ সালে ৭০ শতাংশ নতুন মায়ের তুলনায় কেবল ৭ শতাংশ নতুন বাবা তাদের এই সুযোগ নিয়েছেন। 

ব্যয়বহুল আবাসন

ব্যয়বহুল আবাসন দেশটিতে অনেকের জন্য সন্তান নেয়াকে ব্যাহত করছে। দেশের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা রাজধানী সিউলে বা তার আশেপাশে বাস করছে। ফলে সেখানের আবাসন ও চাকুরি ব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়ছে। স্টেলা এবং তার স্বামীর মতো অনেককেই রাজধানী থেকে আরো দূরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রাজধানী সিউলের জন্মহার ০.৫৫ শতাংশে নেমে এসেছে, যা দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন। 

বেসরকারি শিক্ষা

ব্যয়বহুল আবাসনের পাশাপাশি প্রাইভেট শিক্ষার খরচও এখানে বড় ভূমিকা রাখছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় চার বছর বয়স থেকেই শিশুদের ব্যয়বহুল ক্লাসে পাঠানোর রীতি আছে। সেখানে তাদের গণিত, ইংরেজি, সঙ্গীত এবং তায়কোয়ান্দোতে শেখানো হয়। অসম্ভব প্রতিযোগীতামূলক দেশটিতে যারা শিশুদের প্রাইভেট টিউশনে পাঠান না তাদের ব্যর্থ পিতামাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 

স্টেলার যে স্কুলে শিক্ষকতা করেন সেখানে একজন পিতামাতাকে একমাসে প্রতি সন্তানের জন্য প্রায় ৯০০ মার্কিন ডলার খরচ করতে হয়, যা অনেকেই বহন করতে পারেন না। ২০২২ সালে এক জরিপে দেখা যায়, ৯৪ শতাংশ অভিভাবক প্রাইভেট টিউশনকে আর্থিক বোঝা মনে করেন। 

উল্লেখ্য, দক্ষিণ কোরিয়া সন্তান লালনপালনে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল দেশের একটি।

উপকূলীয় শহর বুসানে স্বামীর সাথে থাকেন মিনজি। স্টেলারের মতো ৩২ বছর বয়সী মিনজিও সন্তান নিতে আগ্রহী নন। 

‘আমাকে সীমাহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছে স্বপ্নগুলি অর্জনের জন্য নয়, কেবল একটি মাঝারি মানের জীবনের জন্য। আমি সারাজীবন লেখাপড়া করে কাটিয়েছি। প্রথমে একটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য এবং তারপরে ২৮ বছর বয়সে প্রথম চাকরি পেতে। কিন্তু আমি একজন শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। আর তাই নিজের সন্তানকে আমার মতো পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে নেয়ার ঘোর বিরোধী আমি’!

দক্ষিণ কোরিয়া উন্নত দেশ হলেও সেখানেও আছে নারী-পুরুষের বেতন বৈষম্য। আর সেজন্যই হয়ত ক্লান্ত আর বিরক্ত ইয়েজিন দেশ ছেড়ে নিউজিল্যান্ড চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেখানে অন্তত নারী ও পুরুষের বেতনে কোনো বৈষম্য নেই

বিবিসি অবলম্বনে

আই. কে. জে/


বিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া নিম্ন জন্মহার কোরিয়ান নারী

খবরটি শেয়ার করুন