শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
৬ই আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাউলের চর্যাগান—বাঙালির আদি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক

🕒 প্রকাশ: ০২:০৭ অপরাহ্ন, ২১শে সেপ্টেম্বর ২০২৪

#

ছবি - সংগৃহীত

রবিউল হক

চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন—এ কথা যেমন সত্য, এটি বাংলা গানেরও আদি নিদর্শন—এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই। চর্যাপদ বাংলা গানের ভুবনে এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। এটি আমাদের শেকড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। বাঙালি জাতি তার নিজস্ব সংস্কৃতি ও শেকড় থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর বিচ্ছিন্ন ছিল। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবার থেকে আমাদের সেই হারানো ঐতিহ্য উদ্ধার করতে সক্ষম হন।

চর্যাপদ যে বাঙালিদের ভাবসম্পদ এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এর প্রতিটি পদে বাঙালির প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। ভাষাগত দৃষ্টিকোণ থেকে এবং শৈল্পিক বিচারে চর্যাপদ এতোটাই সমৃদ্ধ যে বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠী এটি নিজেদের সম্পদ হিসেবে দাবি করে। চর্যাপদ ছিল বৌদ্ধ সহজিয়াদের সাধনসঙ্গীত। আর এর পদকর্তাগণ ছিলেন একেকজন উচ্চ মার্গীয় ভাবসাধক।

চর্যা পদকর্তাগণ যে আমাদের আদি ভাবসাধক ও আদি বাউল এ বিষয়ে দ্বিমত থাকার কথা নয়। চর্যার ১৭ সংখ্যক পদে বলা হয়েছে, ‘সুজ লাউ সসি লাগেলি তান্তী/অণহা দান্ডী বাকি কিঅত অবধূতী’। অর্থাৎ, লাউয়ের খোলের সাথে তারযুক্ত করে বীণা জাতীয় এক ধরনের বাদ্য সহযোগে চর্যার পদকর্তাগণ গান করতেন। এছাড়া এই পদে বুদ্ধ নাট্য শাস্ত্র সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘নাচন্তী বাজিল গান্তি দেবী/ বুদ্ধ নাট্যম বিষমা হোই’। অর্থাৎ, দেবী একই সাথে নৃত্য, গীত ও অভিনয় করছেন। বর্তমান বাউল ধারা মূলত বৌদ্ধ সহজিয়া ধারা হতেই সৃষ্ট। চর্যার ১৯ সংখ্যক পদে লোক বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে। এই পদে পটহ, মাদল, কাসি, ঢোল এসকল লোক বাদ্যের উল্লেখ রয়েছে।

চর্যাপদ পঠন-পাঠন ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখা যায়, এতে পদকর্তাগণ প্রতিটি পদে পটমঞ্জুরী, মল্লারী, রামক্রী, ভৈরবী, দেশাখ, কামোদ, বঙাল, বরাড়ী ইত্যাদি রাগ-রাগিনীর উল্লেখ করেছেন। আর এসব রাগ রাগিনীর বেশির ভাগ আজ বিলুপ্ত।

এছাড়াও চর্যা পদকর্তাগণ তাদের রচনায় ভনিতার ব্যবহার করতেন। যেমন- চর্যাপদের ৪৪তম পদকর্তা বলছেন, ‘ভনই কঙ্কন কলএল সাদে/ছাদে, সব্ বিচ্ছুরিল্ তথতানাদে’। অর্থাৎ, কঙ্কন বলছেন, কলকল শব্দে নমেষেই সব কিছু বিচুর্ণ হয়ে যাচ্ছে। বাংলা লোকগানে বিশেষভাবে বাউল গানে ভনিতার ব্যবহার বেশি লক্ষ্য করা যায়। চর্যাপদের বেশিরভাগ পদে আধ্যাত্মিক চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে। কাজেই এ কথা অকপটে আমরা স্বীকার করতে পারি যে, চর্যাপদ শুধু বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন নয় বরং এটি বাঙালির আদি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং এর পদকর্তাগণ বর্তমান বাউল ভাবধারার আদি ভাবসাধক।

রবিউল হক : লোক গবেষক ও শিল্পী

আই.কে.জে/

চর্যাগান

খবরটি শেয়ার করুন