শনিবার, ১৫ই মার্চ ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩০শে ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অ‌গ্নিঝরা মার্চ

একাত্তরে বাংলাদেশে নির্মম নিষ্ঠুরতা ও বুভুক্ষ মানুষের কাহিনি

নিজস্ব প্রতিবেদক

🕒 প্রকাশ: ০১:১৩ অপরাহ্ন, ৫ই মার্চ ২০২৫

#

‘এক বৃদ্ধ ব্যক্তি তার শার্ট উল্টিয়ে পেটে বেয়নেটের আঘাত দেখালেন। একটি ছোট্র শিশুর কানে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। কারণ, তাকে খুব কাছে থেকে গুলি করা হয়। এক নারী মাঠে বসে কাঁদছেন। তার স্বামীকে গত পরশু জীবন্ত মাটি দেওয়া হয়।’ 

একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ ধরনের বর্বরতা তুলে ধরে রিপোর্ট করেছিলেন লন্ডনের ‘দৈনিক মিরর’ পত্রিকার সাংবাদিক জন পিলগার। ‘বাংলাদেশে নির্মম নিষ্ঠুরতা ও বুভুক্ষ মানুষের কাহিনি’  শীর্ষক এই প্রতিবেদন ১৯৭১ সালের ১৬ই জুন  ‘দৈনিক মিররে’ প্রকাশিত হয়। জন পিলগার বাংলাদেশে অবস্থান করে এবং ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে রিপোর্ট করেছিলেন।

তিনি যেদিন এসব পর্যবেক্ষণ করছিলেন, তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। ‘এখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে, শুধু ধবংসস্তুপের ছায়া দেখা যায়। দুই সপ্তাহ আগে একটি মসজিদ উড়িয়ে দেওয়াসহ দোকান লুটপাট করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। মাটির ঘরের একটি দেয়াল আছে, তা থেকে বাড়ির মালিক পালিয়ে যাননি। তার যুবতী মেয়েটিকে বলাৎকার করা হয়। তাই তিনি পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন’- এভাবে বর্ণনা দেন পিলগার। 

রিপোর্টে পিলগার ঘটনাস্থলের স্থান উল্লেখ করেননি। এ ব্যাপারে তিনি লেখেন, ‘আমি একটি বাজারে এসে দেখলাম  যে, কয়েকজন গ্রামবাসী আছেন, তারা প্রায় সবাই এখানে জড়ো হয়েছেন। আমি গ্রাম বা ডিস্ট্রিকের নাম এখানে উল্লেখ করতে চাই না। কারণ, তা উল্লেখ করলে হয়তো একদিন গ্রামটি ধবংস করে দিতে পারে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তারা ফটোগ্রাফার এরিক পাইপার ও আমাকে  প্রথম বিদেশি দেখতে পান।’

ভারত সীমান্তের পাশে পিলগারের সঙ্গে একজন গেরিলার দেখা হলে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘এখান থেকে প্রায় সবাই চলে গেছেন। তারপরেও পিলগার প্রায় একশজনের মতো লোকের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক মেয়ে এবং তেরো থেকে বিশ বছরের যুবক ছিল। প্রতিটি পরিবারের সদস্য যাদের সঙ্গে তার কথা হয়েছে, তাদের সবাই বলেছেন, কারো ছেলে, স্বামী বা ভাইকে গুলি করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে এবং মেয়ে বা স্ত্রীর শালীনতাহানি করেছে।’

কাসিম উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি পিলগারকে বলেন, ‘গত ২৪ই মে তার দুই ছেলেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা নদীর কিনারে গর্তে পুতে কাদামাটিতে চাপা দিয়ে মেরে ফেলে। পিরালি নামে আর একজন বলেন, সৈন্যরা এখানে আসতে শুরু করলে তিনি তার বোন ও  ভাতিজাসহ নৌকা করে পালাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের দিকে মেশিনগান তাক করলে তারা ফিরে আসেন। তবে পিরালি কোনো প্রকারে প্রাণে রক্ষা পেলেও বোন ও ভাতিজাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।’

বাংলাদেশে যাওয়ার পথে দুজন জাতীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গেও দেখা হয় বলে পিলগার তার রিপোর্টে উল্লেখ করেন। তাদের একজনের নাম ইকবাল আনোয়ারুল ইসলাম, আরেকজনের নাম মোল্লা জালাল উদ্দিন। আনোয়ারুল ইসলাম  পিলগারকে জানান, ‘পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সদস্যরা সংখ্যালঘু, হিন্দু ও খ্রিষ্টানসহ শিক্ষক, ডাক্তার ও যুবকদের প্রক্রিয়াগতভাবে নিধন করে যাচ্ছে।’ তিনি আরো জানান, ‘ষাটটি ছেলেকে পাকিস্তান সৈন্যরা জোর করে ধরে নিয়ে গেছে, যার মধ্যে তার ১৬ বছর বয়সের ছেলেটিও রয়েছে।‘ জালাল উদ্দিন বাংলাদেশে পাকিস্তানের এই বর্বরতা নিয়ে ব্রিটেন বাংলাদেশের জন্য কেন কিছু করছে না,  তা  জানতে চান।

পিলগার তার রিপোর্টে আরো লেখেন, ‘ভারত উপমহাদেশ ভাগের পর যে দেশটি বাংলাদেশ নামে পরিচিত, সেখানে বাঙ্গালিদের জেনারেল ইয়াহিয়া খানের পশ্চিম পাকিস্তান সরকার বিভিন্ন পদ্ধতিতে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধে লিপ্ত।’ নিষ্ঠুরতার লক্ষণ প্রতিটি গ্রামে প্রায় একই রকম বলেও উল্লেখ করেন দৈনিক মিররের এই সাংবাদিক।

কেসি/এইচ.এস


অ‌গ্নিঝরা মার্চ

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন