ছবি - সংগৃহীত
শিক্ষার মূল হলো প্রাথমিক শিক্ষা। এখানে একটি শিশুকে হাতে-কলমে শিক্ষা দেয়া হয়। সেই শিক্ষায় নিজেকে প্রস্তুত করে ওই শিশু ধীরে ধীরে উচ্চতর শিক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত করে। অথচ আমাদের শিক্ষার মূলেই গলদ। প্রাথমিকে যারা শিক্ষা দেন তাদের বেশির ভাগই মানসম্মত শিক্ষক নন। তাহলে তারা শিশুদের কী শিক্ষা দেবেন?
শিক্ষার মানের উন্নতির প্রথম শর্ত হলো ভালো শিক্ষক। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। যাদের শিক্ষক হওয়ার কথা নয়, তারা দুর্নীতির সুযোগ নিয়ে চাকরি পাচ্ছেন। এছাড়া অনেকে আছেন অন্য কোনো চাকরি না পেয়ে প্রাথমিক শিক্ষক হচ্ছেন।
অথচ মাধ্যমিকের চেয়ে প্রাথমিকের শিক্ষকতা করা কঠিন একটি কাজ। এখানের শিশুরা স্পর্শকাতর ও কোমলমতি। তাই প্রাথমিকের শিক্ষকদের দায়িত্বটা অনেক বেশি থাকে। কিন্তু এখানে চাকরি করছে কম যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ।
অন্যান্য যে কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমের আকার সর্ববৃহৎ। সারা দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। পয়ষট্টি হাজার বিদ্যালয়। চৌষট্টিটি ট্রেনিং প্রতিষ্ঠান। সাড়ে তিন লাখের বেশি শিক্ষক। শিক্ষা মনিটরিংয়ের জন্য প্রতিটি উপজেলায় অফিস। তারপরও প্রাথমিক শিক্ষার ভালো মান নিশ্চিত করা যায়নি।
বিগত সরকারের সময় একযোগে ছাব্বিশ হাজার রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয়েছিল। সেটি সরকারের সাহসী ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিল। প্রতিটি স্কুলে তিন-চার জন শিক্ষক ছিলেন। তাদের কেউ পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষক হননি। কেউ জমি দিয়ে, কেউ অনুদান দিয়ে শিক্ষক হয়েছেন। সে সব স্কুলের শিক্ষার মান খুবই খারাপ।
প্রাথমিক স্কুলে গণিত ও ইংরেজির মান খুবই খারাপ। এসব বিষয় পড়ানোর ভালো মানের শিক্ষক নেই। যার কারণে তারা প্রাথমিক থেকে দুর্বলতা নিয়ে আসে, উচ্চমাধ্যমিকে যাওয়ার পর অনেক ছাত্র ঝরে যায়।
উন্নত দেশগুলোর সরকার শিক্ষার সব ধাপের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী পড়ে প্রাইমারি স্কুলগুলোয়। এরপর মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে এ লেভেল, ও লেভেল করে কর্মজীবন বেছে নিতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ কেউ গ্রাজুয়েট হয়। এরপর যারা গবেষণার সঙ্গে যুক্ত থাকতে চায় তারা থেকে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ধাপে গবেষণা করতে আসা বিদেশিদেরই দেখা যায় বেশি। সেসব দেশে চাকরিতে প্রবেশ করার জন্য আমাদের দেশের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াটা জরুরি নয়।
উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর ভিত্তিটি শক্ত করার দিকে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি দেয়া হয়। ফলে সরকার ও সমাজের প্রাইমারি শিক্ষার মান শতভাগ উন্নত রাখার প্রতি তীক্ষ্ণ নজর থাকে। সেখানে একজন প্রাইমারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে হলে সবচেয়ে মেধাবী হতে হয়। শিশু মনস্তত্ত্বের ওপর শিক্ষকের পড়াশোনা থাকে। বিশেষ বিষয় নয়- সব বিষয়ে একজন শিক্ষককে পাঠদানে সক্ষম হতে হয়। কারণ, শিক্ষককে অনেক সময় একটি ক্লাসের সব দায়িত্বই বহন করতে হয়।
আমাদের দেশের প্রাইমারি শিক্ষার ক্ষেত্রে দুরবস্থার আরেকটি প্রধান কারণ হলো শহর-গ্রামের শিক্ষার বৈষম্য। শহরকেন্দ্রের বাইরের স্কুলের বিপন্ন দশা। বড়লোকের কিন্ডারগার্টেন আর এ লেভেল-ও লেভেল স্কুলের জোয়ারে সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। এক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্বও কম নয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্বল্প বেতন দিয়ে মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগের আশা করা যায় না। আর মেধাবী ছাত্ররা যদি শিক্ষকতা পেশার প্রতি আকৃষ্ট না হয়, তাহলে ভালো শিক্ষক তৈরি হবে না। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভালো বেতন ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রাইমারি শিক্ষাকে যদি আধুনিক না করা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি সমৃদ্ধ করা না যায়, বেতন কাঠামো সংস্কার করে যদি মেধারীদের শিক্ষক হওয়ার দিকে উৎসাহিত করা না যায়, তাহলে দেশের শিক্ষার ভিত্তিটিকে কখনো সবল করা সম্ভব হবে না।
আই.কে.জে/