মঙ্গলবার, ১৬ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১লা শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চাদর পুড়িয়ে অর্থনীতি ধ্বংসের পাঁয়তারায় বিএনপি

উপ-সম্পাদকীয়

🕒 প্রকাশ: ০২:২৭ অপরাহ্ন, ১লা এপ্রিল ২০২৪

#

বিশ্ব মাতব্বর হওয়ার বাসনা সব দেশের থাকা উচিৎ। বিশ্ব মোড়ল হতে চায় সকলে। এই মূহুর্তে বিশ্ব মোড়লের তালিকায় আছেন রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন, যুক্তরাষ্ট্রের জো বাইডেন ও চীনের শি জিনপিং। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা চীনের চেয়ে কম। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া শুধু জনগণের ওপর ভর করে শক্তিশালী উন্নত দেশ হয়নি। অন্য আরো খাত দিয়ে তারা উন্নত। চীনের উন্নয়নে শুধু জনগণ মুখ্য ভূমিকা রাখেনি, পাশাপাশি তারা অন্যান্য ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে। বিশেষ করে এই তিনটি দেশ সামরিক শক্তিতে বলিয়ান। তারা খাদ্যেও স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারা বরং খাদ্যশস্য, সামরিক সরঞ্জামসহ নানাবিধ পণ্য ও সেবা রপ্তানি করে থাকে।    

জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভারত পৃথিবীর শীর্ষে। এরপর যথাক্রমে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, ব্রাজিল, বাংলাদেশ, রাশিয়া ও ইথিওপিয়া। এই দশটি দেশের মধ্যে আমাদের ভৌগলিক আয়তন সবচেয়ে কম। বলা যেতে পারে, আফ্রিকা মহাদেশের ইথিওপিয়া ও নাইজেরিয়া ছাড়া অন্য আটটি দেশ আমাদের চেয়ে উন্নত। কিছু সূচকে ভারত-পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে। 

কিন্তু সমগ্র অর্থনীতিতে বাংলাদেশ পিছিয়ে। উইকিপিডিয়ার তথ্যমথ্যে, বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৯তম, ক্রয় অর্থনীতিতে ২৯তম। অবশ্য আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, পঁয়ত্রিশ বৃহত্তর অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশে। এই উল্লম্ফন সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। তবে দেশের অর্থনীতি অনেকটা আমদানি নির্ভর। অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জাপান সবার সেরা। 

উক্ত দশটি দেশের তুলনায় ছোট হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের জনসংখ্যা অত্যন্ত বেশি। এজন্য বিভিন্ন জিনিসপত্র আমদানি করতে হয়। আমদানির তুলনায় রপ্তানি কম।

আমদানি-রপ্তানির হেরফের বুঝতে পরিসংখ্যানে নজর দিতে চাই। ২০২৩ সালের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) সার্বিক লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ হাজার ৯৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা পূর্ববর্তী অর্থবছরে ছিল ২ হাজার ২২২ মিলিয়ন ডলার। এই ঘাটতির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে। তেইশের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের (বিবি) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩২ হাজার ২৬৭ মিলয়ন ডলার; যা পূর্ববর্তী বছরে ছিল ৪৫ হাজার ৯৪৮ মিলিয়ন ডলার। এই রিজার্ভ দিয়ে দেশের ৪ মাসের বেশি আমদানি ব্যয় মিটানো সম্ভব ছিল। একই সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমেছে।

বিগত অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৩৭ হাজার ৭৮ মিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে। এর আগের বছর আয় হয় ৩৩ হাজার ৮৪৩ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বিগত অর্থবছরে ৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি আয় হয়। এর মধ্যে তৈরি পোশাক ও নীটওয়্যার খাত থেকে ৮৫ শতাংশ আয় করে বাংলাদেশ। অবশ্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ২০২২-২৩ সালে ৬২ হাজার মিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য ও সেবা রপ্তানি করা হয়েছে। 

দেশভিত্তিক রপ্তানি উপাত্তে দেখা যায়, বাংলাদেশী পণ্যের প্রধান আমদানিকারক দেশ হিসেবে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি। তারা যথাক্রমে ৬ হাজার ৪৩৯ মিলিয়ন ও ৪ হাজার ৯০৬ মিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য আমদানি করে। দেশের মোট রপ্তানির সতের ও তেরো শতাংশ রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে। তারা হিমায়িত কাঁকড়া ও চিংড়ি, গৃহস্থালী বস্ত্র, তৈরি পোশক ও নীটওয়্যার নেয় বাংলাদেশ থেকে। এরপর রয়েছে যথাক্রমে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। এছাড়া বেলজিয়াম, ইতালি, নেদারল্যান্ড, কানাডা ও জাপান উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পণ্য বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর যে তথ্যসারণি অর্থনৈতিক সমীক্ষার প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে, সেখানে ভারত ও চীনের নাম নেই। চীন শুধু বাংলাদেশে রপ্তানি করে কিন্তু তারা সেই তুলনায় কোনো পণ্য বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে না। প্রায় একই অবস্থা ভারতেরও।  

গত অর্থবছরে ৫২ হাজার ৭১৩ মিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় মিটানো হয়েছে। এর আগের বছর ৫৮ হাজার ৭৭৪ মিলিয়ন ডলারের পরিমাণ আমদানি করা হয়। অপেক্ষাকৃত পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় আমদানি কম হয়েছে। তবে গত কয়েক বছরের সাথে বিগত অর্থবছরের তুলনা করলে দেখা যায়, আমদানি তেমন একটা হ্রাস পায়নি। 

পণ্য আমদানি মূল্যের ভিত্তিতে ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে বিগত অর্থবছর পর্যন্ত দেশে চীন থেকে বেশি আমদানি করা হয়। আলোচ্য সময়ে মোট আমদানি ব্যয়ের ২৭ দশমিক ২৮ ভাগ অর্থ চীনকে দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত (প্রায় সাড়ে বারো শতাংশ) ও জাপান (সাড়ে তিন ভাগ)। এছাড়া সিঙ্গাপুর, হংকং, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও মালেয়েশিয়া থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পণ্য-সেবা আমদানি করা হয়। বিবি ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উপাত্ত দিয়ে তেরি করা হয়েছে অর্থনৈতিক সমীক্ষা। 

বিভিন্ন দেশ থেকে কয়লা, গ্যাস, সিমেন্ট ক্লিংকার, সোনা, স্টিল পণ্য, বিটুমিন, পুরাতন জাহাজ, চাল, গম, পেঁয়াজ, রসুন, তৈলবীজ, অপরিশোধিত পেট্রোলিয়াম, পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যসামগ্রী, সার, তুলা, ভোজ্যতেল, স্টেপল ফাইবার, সূতা, মূলধনী যন্ত্রসামগ্রী ও চিকিৎসা সামগ্রী আমদানি করা হয়।  

অর্থাৎ দেশে রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি। এজন্য রপ্তানি উন্নয়নে সরকার বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। রপ্তানিকারককে নগদ সহায়তা প্রদান, রপ্তানি পণ্য বহুমুখিকরণ, রপ্তানি বাজার বহুমুখিকরণ ও বাংলাদেশি দূতাবাসে বাণিজ্যিক উইং স্থাপন করা; যেন কাঙ্খিত মাত্রায় রপ্তানি করা সম্ভব হয়।

সরকার ইতিমধ্যে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্প্রসারণে বিভিন্ন দেশের সাথে ৪৫টি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। যেমন টিকফা, পিটিএ, অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি-ইপিএ এবং মুক্তবাণিজ্য চুক্তি-এফটিএ। এছাড়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, বিমসটেক, সাটিস, সাফটা, আঙ্কটাড, আসিয়ান, আপটা, ওআইসি, মার্কোসুর এবং মুসলিম গরিষ্ঠ উন্নয়শীল আট দেশ (ডি-৮) বিশিষ্ট জোটের সদস্য বাংলাদেশ। 

সরকার বিভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্য সম্প্রসারণে পণ্য, সেবা ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক সহযোগিতার অভিপ্রায়ে কমপ্রিহেনসিভ ইকোনোমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (সিইপিএ-সেপা) চুক্তি করার উদ্যোগ নিয়েছে, যা চলমান। বাণিজ্য করতে কমনওয়েলথ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ইউনেসক্যাপের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখছে সরকার। তাছাড়া আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা পায় বাংলাদেশ।

২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের গড় প্রায় একই রকম ছিল। করোনায় ২০২১ সাল থেকে ডলারের দাম বেড়ে যায়। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার গড় বিনিময় হার ৯৭ দশমিক ২৬ শতাংশে দাঁড়ায়। এতে খরচ বেড়ে যায় পণ্য আমদানিতে। ফলে দেশে পণ্যের দাম বেড়ে যায়।

বিবির ২০২২-২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, সমগ্র বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। ২০২১ সালে সারাবিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৩, সেটা চলতি বছরে নেমে আসবে ২ দশমিক ৯-এ। একুশ সাল থেকে পাকিস্তান ও শ্রীলংকার প্রবৃদ্ধির হার ক্রমাবনতি হয়েছে, এটা এখনও চলমান। তবে করোনার একুশ-বাইশ সালে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশের মতো ছিল, কিন্তু গত দুই বছরে ৬ শতাংশে দাঁড়ায়। করোনায় ভারতের প্রবৃদ্ধি একুশ-বাইশ সালে যথাক্রমে ৯ ও ৭ শতাংশের ওপরে ছিল। এরপর দুই বছরে ৬ দশমিক ৩ শতাংশে দাঁড়াবে।  

বিবি জানাচ্ছে, গত বছর প্রবাসীরা দেশে ২১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন। এটি আগের বছরের তুলনায় দুই দশমিক ৫৪ শতাংশ বেশি। বাইশ সালে রেমিট্যান্স আয় ছিল ২১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার ও একুশ সালে তা ছিল ২১ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার। সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালি থেকে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আসে।

উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটা খাতে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার চেষ্টা করছেন। খাদ্যশস্য, মৎস্য, ফলমূল ও মাংস উৎপাদনে ২০০৬ সালের তুলনায় কয়েক গুণ এগিয়েছে দেশ। তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনিতে এগিয়েছে দেশ। শিক্ষায় এগিয়েছে নারীরা; এসব নিয়ে অন্য নিবন্ধে লিখবো বিস্তারিত। এ উন্নতি সহ্য হচ্ছে না বিএনপির। আন্তর্জাতিক অঙ্গণে রাজনৈতিকভাবে চাপে পড়ে বিএনপি দেশকে অবনতির দিকে নিয়ে যাওয়ার পাঁয়তারা করছে। চাদর পোড়ানো বিএনপির রুহুল কবির রিজভী আহমেদকে আহ্বান জানাবো- শেখ হাসিনার উন্নয়নে শামিল হতে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বাবলম্বী হতে শেখ হাসিনাকে সহযোগিতা করতে। শেখ হাসিনা ছাড়া কেউ উন্নয়নে উপযুক্ত নন। তার নেতৃত্ব অনস্বীকার্য। তাই আমদানি কমিয়ে রপ্তানি কিভাবে বাড়ানো যায়, তাতে সহযোগিতা করতে পারে বিএনপি।

চাদর পুড়লে আমদানি বৃদ্ধি পাবে, অর্থনীতি চাপে পড়বে। রাজনীতিতে সফল হতে না পেরে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করতে চায় বিএনপি। কিন্তু এটা হতে দিতে পারেন না শেখ হাসিনা। 

অজিত কুমার মহলদার, প্রাক্তন নির্বাহী সদস্য, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন। azit.mohaldar@gmail.com

আই.কে.জে/ 

অজিত কুমার মহলদার

খবরটি শেয়ার করুন