সোমবার, ৮ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২৪শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সতর্কতা: আগস্ট মাস হতে পারে ডেঙ্গুর 'পিক সিজন'

স্বাস্থ্য ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ১০:১১ অপরাহ্ন, ১লা আগস্ট ২০২৩

#

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগের মৌসুম ধরা হয় মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ডেঙ্গু সারা বছরব্যাপী হচ্ছে। এরমধ্যে আক্রান্তের গ্রাফ সবচেয়ে ওপরের দিকে থাকে জুলাই ও আগস্ট মাসে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জুনে যে-সংখ্যক মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছিল তার চেয়ে সাত গুণ বেশি আক্রান্ত হয়েছে জুলাইয়ে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আগস্ট মাসে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কেমন হতে পারে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগস্টে বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে, এবং এ মাস হতে পারে চলতি বছরের ‘পিক সিজন’।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেছেন, আগস্ট মাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকবে বলে তাদের অনুমান।

তিনি বলেন, “যত বৃষ্টিপাত হবে, গরম বেশি পড়বে, যত আর্দ্রতা বাড়বে যত বেশি অপরিকল্পিত নগরায়ন হবে, তত বেশি ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার সংখ্যা বাড়তে থাকবে। এডিসের জন্য আমরা সারা বছর একটা অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছি।”

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, গত বছরের চেয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত এবং মৃত্যুর প্রকোপ কয়েকগুণ বেশি। এমন পরিস্থিতি সবশেষ দেখা গিয়েছিল ২০১৯ সালে।

চার বছর আগে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছিল এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন এবং মৃত্যু হয়েছিল ১৭৯ জনের।বাংলাদেশে ওই বছরই রেকর্ডসংখ্যক রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল।

তবে দেশে সর্বোচ্চ সংখ্যক ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছিল গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে, মোট ৬১ হাজার রোগীর মধ্যে ২৮১ জন মানুষের মৃত্যু হয়।

এবারের পরিস্থিতি ২০১৯ সালের আক্রান্ত এবং ২০২২ সালের মৃত্যুর রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞরা।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ৩০শে জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ৪৯ হাজার ১৩৮ জন। এ সময়ে মারা গেছেন ২৪৭ জন। এরমধ্যে শুধু জুলাই মাসেই আক্রান্ত হয়েছে ৪১ হাজার ১৬০ জন, এবং মারা গেছেন ২০০ জন।

এর আগে ২০১৯ সালের জুলাই মাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৬ হাজার ২৫৩ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৪০ জনের। ওই বছর অগাস্ট মাসে আক্রান্তের সংখ্যা এক লাফে বেড়ে ৫২ হাজার ৬৩৬ জনে দাঁড়ায়। মারা যান ৯০ জন।

চলতি বছরের অগাস্টেও পরিস্থিতি বিরূপ আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

এ বছরের শুরু থেকেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি এবং এ পর্যন্ত রেকর্ডসংখ্যক ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে।

'পিক সিজন' হওয়ার সম্ভাব্য কারণ

গত পাঁচ বছরে ডেঙ্গু রোগীর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ডেঙ্গুতে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত যত মানুষ রোগী মারা গেছে, তা এর আগে কোনও বছরের প্রথম ছয় মাসে হয়নি।

এ বছর দেশের ৬৪টি জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। এর আগে কেবল ২০১৯ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া গিয়েছিল।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার তার পরীক্ষাগারে এডিস মশার ঘনত্ব, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং বৃষ্টিপাত- এই কয়েকটি বিষয়কে কম্পিউটার সিমুলেশন মডেলের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করেন।

সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তিনি আশঙ্কা করছেন, বর্তমানের ডেঙ্গু পরিস্থিতি অগাস্ট মাসে আরও ভয়াবহ হবে এবং সেটাই হতে পারে 'পিক সিজন'।

কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, ডেঙ্গুর ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার ধরন ও বৈশিষ্ট্য বদলানোর কারণে এদের প্রকৃতিতে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা এখন আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।

আগে যেখানে এই মশা শুধু দিনের বেলায় কামড়াত, এখন এটি দিনে রাতে দুই বেলায় কামড়ায়।

আগে যেখানে মশাটি স্বচ্ছ পানিতে বংশবিস্তার করতো, বর্তমানে ময়লা পানিতেও এর অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে।

বাইরের কৃত্রিম আলোতে সক্রিয় থাকায় এই মশা লম্বা সময় ধরে ডেঙ্গু সংক্রমণ করে যেতে পারছে।

অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন, বর্ষা দেরিতে শুরু হওয়ায় ডেঙ্গু মৌসুম দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া মশার বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তনসহ মানুষের আচরণগত কারণে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু বিস্তার লাভ করছে।”

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা সংস্থা আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন জানিয়েছেন, বৃষ্টির সাথে এডিস মশার প্রজনন বাড়ে।

"অগাস্টে বৃষ্টি সিজন থাকে পুরোপুরি, এ সময় এডিস মশা তার বংশ বিস্তারের জন্য সবচেয়ে উপযোগী পরিবেশ পায়। তাছাড়া বছরের এই সময়ে নির্মাণ কাজ বেড়ে যায়। পানির ব্যবহার বাড়ে। সেখানেও মশা বিস্তার লাভ করে।"

গত বছর বাংলাদেশে ডেঙ্গুর পিক সিজন ছিল অক্টোবর ও নভেম্বরে এবং এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত রোগ শনাক্ত হয়েছে।

এমনটা আগে কখনও হয়নি। সেক্ষেত্রে অগাস্ট থেকে সামনের চার মাসই ডেঙ্গু বিস্তারের জন্য আশঙ্কার বলে শংকা প্রকাশ করেন তিনি।

এদিকে, অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলছেন, “গত বছর ঢাকায় এডিস মশার ওপর জরিপ করে দেখা গিয়েছে ঢাকায় অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে কমিউনিটিতে মশার উপদ্রব প্রচুর বেড়েছে।

বিশেষ করে বহুতল ভবনগুলোয়, পার্কিংয়ে সারাবছর পানি থাকে, এছাড়া নির্মাণাধীন ভবন এবং বাসাবাড়িতে জমিয়ে রাখা ওয়াসার পানি, ওয়াসার চৌবাচ্চার লিকেজ থেকে জমা পানি এমন চারটি স্থানে এডিসের লার্ভা পাওয়া গিয়েছে।"

"এখানে বৃষ্টির কোন যোগসূত্র নেই। যে কারণে ডিসেম্বর, জানুযারীতেও ডেঙ্গু হল। এরপর আবার এপ্রিলে বৃষ্টি শুরু হলে মশা তার প্রচুর প্রজনন ক্ষেত্র পেল, ডিম পাড়ার জায়গা পেল। যার কারণে ডেঙ্গু রোগী বাড়ল।” তিনি বলেন।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এডিস মশার বিরুদ্ধে অবিলম্বে কোনও কর্মসূচি না নিলে আগামী দিনে ভয়াবহ বিপর্যয় আসতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন।

সিটি করপোরেশনের আয়ত্তে নেই

মশা নিয়ন্ত্রণের পরিস্থিতি এখন আর সিটি কর্পোরেশনের একার আয়ত্তে নেই বলে মনে করেন কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার।

এক্ষেত্রে মশার বিস্তার ঠেকাতে সিটি কর্পোরেশনের পাশাপাশি বাংলাদেশে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

সেইসাথে সিটি কর্পোরেশনকে সারা বছর মশা নিধন অভিযান চালিয়ে যাওয়ার কথা জানান অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক রোবেদ আমিন।

তিনি বলেন, “ডেঙ্গু সম্পূর্ণ নির্মূল করা যাবে না। কোনও দেশ পারেনি। কিন্তু একে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব যেটা সিটি কর্পোরেশন একা পারবে না।”

এক্ষেত্রে ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতার ওপর বেশি জোর দিয়েছেন তিনি। বিশেষ করে তিনি প্রত্যেকটি বাসাবাড়ির ছাদে, আঙিনায় কিংবা অন্য কোনো খানে যাতে এডিস মশা জন্মাতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে বলেছেন।

গত ১৮ই জুন থেকে ২৭শে জুন পর্যন্ত ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ৯৮টি ওয়ার্ডে এক জরিপ পরিচালনা করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সেখানে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অধীনে ৫৫টি ওয়ার্ড ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানানো হয়।

ডিএনসিসির ৪০টি ওয়ার্ড ও ডিএসসিসির ৫৮টি ওয়ার্ডের ৩,১৪৯টি বাড়িতে জরিপ চালিয়ে সেখানকার ৫৪৯টি বাড়িতে এডিসের লার্ভা পাওয়া যায়।

আরো পড়ুন: মশা নিধনে এবার র‍্যাট নামাচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি

এমন অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর বিস্তার ঠেকাতে, এই মুহূর্তে ডেঙ্গুর হটস্পটগুলোতে এডিস মশা দূর করতে ফগিং ব্যবহার করা গুরুত্বপূর্ণ৷

ডেঙ্গু রোগীদের ঠিকানা বের করে, ওই ব্যক্তির বাড়ির আশেপাশে ফগিং করে উড়ন্ত মশাগুলোকে মেরে ফেলার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কারণ এই উড়ন্ত মশাগুলো যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন জ্যামিতিক হারে ডেঙ্গু ছড়াবে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু সংক্রমণ দেখা গিয়েছিল ১৯৬৪ সালে ঢাকায়। পরে ২০০০ সালে সাড়ে পাঁচ হাজার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়, মৃত্যু হয় ৯৩ জনের।

ওই বছর সরকার দেশে প্রথম ডেঙ্গুকে রোগতত্ত্বের জায়গায় গুরুত্ব দেয়া হয় বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের থেকে জানা গিয়েছে।

সে হিসেবে গত ২৩ বছরে (২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত) বাংলাদেশে তিন লাখের বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। এর মধ্যে মারা গেছেন ১০৫০ জনের মতো রোগী।

এসি/ আইকেজে 



ডেঙ্গু

খবরটি শেয়ার করুন