সোমবার, ৮ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২৩শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইউএনএইচআরসি’র অধিবেশনে একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যার উপর বিবৃতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

🕒 প্রকাশ: ০১:১৯ পূর্বাহ্ন, ১লা জুন ২০২৩

#

১৯৭১ সালে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানের চালানো গণহত্যা : ছবি-সংগৃহীত

বাংলাদেশি প্রবাসী সংগঠন, স্টিচিং বাসুগ (বাংলাদেশ সাপোর্ট গ্রুপ), জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের বিশেষ সংস্থা (ইসিওএসওসি), আমরা একাত্তর (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখা এবং একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য একটি সংস্থা), প্রজন্ম ৭১ (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সন্তানদের নিয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠান), ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরাম (ইবিএফ) এবং সিরাজী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার ও দোসর বাহিনী দ্বারা বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে সংঘটিত ১৯৭১ সালের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদানের দাবিটি পুনর্ব্যক্ত করে নিম্নলিখিত বিবৃতি জারি করেছে:

আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার পরিকল্পনাকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের বিহারি ও বাংলাদেশি দোসরেরা তাদের এ গণহত্যা সংঘটনে সাহায্য করে। এ গণহত্যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সংঘটিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণহত্যা। এ সময় প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়, ২ লক্ষেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ করা হয় এবং প্রায় ১ কোটি মানুষ তাদের পৈতৃক ভিটা ও সম্পত্তি ছেড়ে নিজের জীবন বাঁচাতে এবং স্ত্রীলোকদের সম্মান রক্ষা করতে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। তাছাড়াও প্রায় ২ কোটি মানুষ নিরাপত্তার সন্ধানে দেশের ভেতরেই বাস্তুচ্যুত হয়। সারাবিশ্বের লাইব্রেরি ও আর্কাইভে পাওয়া খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন এবং প্রকাশনাগুলো এই সত্যের সাক্ষ্য বহন করে। সিনেটর টেড কেনেডি ভারতে শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। তথ্য অনুসন্ধানের জন্য তিনি তৎকালীন বাংলাদেশে প্রবেশ করতে চাইলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাকে বাধাপ্রদান করে। তার পরবর্তী বক্তৃতা, আলোচনা এবং মার্কিন সিনেটে প্রদানকৃত প্রতিবেদন পাকিস্তানিদের নৃশংসতার যথেষ্ট প্রমাণ প্রদান করে।

ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অফ জুরিস্ট একটি তদন্ত সংস্থা গঠন করে যা পাকিস্তানের অসহযোগিতার কারণে তার মিশন সম্পূর্ণ করতে পারেনি। অবশেষে ১৯৭২ সালে তারা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বিস্তারিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংক্রান্ত আইনি বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করা হয়। ঢাকায় মার্কিন মিশনের পাঠানো প্রতিবেদন এবং যুক্তরাজ্যের দাতব্য সংস্থা অক্সফাম দ্বারা সংকলিত ও প্রকাশিত সাক্ষ্যসহ অন্যান্য নথিগুলো বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যাকে প্রমাণ করে।

বাংলাদেশের ইতিহাস অনিবার্যভাবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িয়ে আছে। ১৯৭১- সহিংসতা ও রক্তপাতের গল্প। পশ্চিম পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনি এ দেশে যে হত্যাযজ্ঞ চালায় তারই অবশিষ্টাংশ থেকে বাংলাদেশের নবজন্ম। পশ্চিম পাকিস্তানিদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানিদের কাছে আর কোনও বিকল্প ছিল না। জাতীয় নির্বাচনে নিশ্চিত জয় সত্ত্বেও পাকিস্তানি সরকার পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নি। উপরন্তু আওয়ামী লীগের ডাকা অসহযোগ আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর অপারেশন সার্চলাইট নামক ঘৃণ্য গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ২৬ মার্চ ভোররাতে বাঙালিদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। 

পাকিস্তানি শিবিরে ধর্ষণের শিকার নারীরা অনেকেই স্বেচ্ছায় গর্ভপাত করতে চাইলে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের একটি দল গঠনে সহযোগিতা করে। বীরাঙ্গনারা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনি দ্বারা সংঘটিত পদ্ধতিগত অভিযানের শিকার হন। বাঙালি জাতিদের মধ্যে তাদের রক্ত বা সন্তানের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে বাঙালি জাতিকে পরিবর্তনের এক ঘৃণ্য প্রচেষ্টা করে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনি। পাকিস্তান সেনাবাহিনি সংগঠিতভাবে ধর্ষণকে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা পরিচালিত বিশেষ ক্যাম্পে তরুণী ও মহিলাদের অপহরণ করা হয় এবং গণধর্ষণ করা হয়।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নির্দেশ অনুযায়ী, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনি এবং রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস নামের তাদের দোসরেরা বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবিদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। দেশকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পঙ্গু করার জন্য এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তান।

পাকিস্তান সামরিক বাহিনি ও তাদের মিত্রদের দ্বারা সংঘটিত ১৯৭১ সালের গণহত্যা আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে ভালোভাবেই নথিভুক্ত হয়। সেই সময়ের কূটনৈতিক চিঠিপত্র ও সংসদীয় প্রতিবেদনগুলো এ গণহত্যার কথা স্বীকার করে। দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য টাইমস, দ্য সানডে টাইমস, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, তাস, এএফপি এবং অন্যান্য সংবাদসংস্থাসহ বিশ্ব মিডিয়া পাকিস্তান কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন করে। পাকিস্তানি সাংবাদিক, এন্থনি মাসকারেনহাস সর্বপ্রথম দ্য সানডে টাইমস অব লন্ডনে এই গণহত্যার কথা প্রকাশ করেন। সত্য কথা বলার অপরাধে খোদ পাকিস্তানি নাগরিক এন্থনিকে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে বেড়াতে হয়। মার্কিন কূটনৈতিক আর্চার ব্লাড এর টেলিগ্রামগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র পরিষেবার প্রতি তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ পায়। তিনি বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার সময় তার নিজের দেশের সরকারের উদাসীনতার তীব্র সমালোচনা করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ শুরু হওয়া গণহত্যা, যা সাংকেতিকভাবে অপারেশন সার্চলাইট নামে পরিচিত, তা ২৫ মার্চেই শেষ হয়ে যায় নি বরং সারা যুদ্ধের সময় এই গণহত্যা জারি থাকে।

গণহত্যা সম্পর্কিত অধ্যয়ন ও গবেষণাগুলোও ১৯৭১ সালের ঘটনাকে গণহত্যা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ২০২১ সালের শেষ দিকে এবং ২০২২ সালের শুরুতে, গণহত্যা প্রতিরোধ বিষয়ক বেসরকারি সংস্থা, লেমকিন ইন্সটিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন, জেনোসাইড ওয়াচ এবং ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন অফ সাইটস অফ কনসাইন্স ১৯৭১ সালের ঘটনাকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ জেনোসাইড স্কলারস (আইএজিএস) সম্প্রতি একটি বিবৃতি জারি করে গণহত্যাকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এর থেকেই প্রমাণিত হয় সত্য কোনদিনও চাপা থাকে না। দ্য ওয়ার্ল্ড বডি অফ জেনোসাইড স্কলারশিপ সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যার উপর যে ডকুমেন্টেশন পাওয়া যায় তা জাতিসংঘ এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতির জন্য যথেষ্ট।

আই.কে.জে/

Important Urgent

খবরটি শেয়ার করুন